সিঁদুরে আম লাল টুকটুক

126

একটা আম, দুইটা আম, তিনটা আম! লাল টুকটুক সিঁদুরে আম। টোকা দিলেই রস বেরিয়ে পড়বে। লুঙ্গির কোঁচায় করে আম তিনটা এনে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে অনিক। খুব যত্ন করে। এমনি এমনি তো এগুলো পাওয়া যায়নি। এক ঘন্টা কাজ করিয়ে নিয়ে তবেই না আম দিয়েছেন বড়মা। বড় চাচীকে ওরা বড়মা ডাকে।
অনিকদেরও আম গাছ আছে। তবে সেই আম টক।
অথচ বড়মাদের আম খুব মিষ্টি আর সুস্বাদু। দেখতেও চমৎকার। কিন্তু বড়মা এমনি এমনি আম দেবে না। কাজ করে দিতে হবে। এই যেমন এখন ধান কাটা-মাড়াইয়ের সময়। ধান মাড়াইয়ের পর আটি বাঁধা খড়ের স্তুপ উঠোনজুড়ে। এই আটি খুলে খড় ছড়িয়ে দিতে হয় খোলা জায়গায়। এরপর গরুর দিয়ে মলন মাড়া হয়। এসময় ৫০টি আটি ভাঙলে একটি আম দেওয়া হবে। সেই ঘোষণা শুনেই অনিকসহ আরো অনেকেই সকালে কাজে হাত দিয়েছে।
স্কুলে যাওয়ার আগে ১৫০টি আটি ভাঙ্গে অনিক। এরপর স্কুলের সময় হয়ে যাওয়ায় ঘরে ফিরে আসে। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। অনিক খুব ভালো ছেলে। নিজেদের বাড়ির অনেক কাজ করে, মা-বাবাকে সাহায্য করে। আবার বড়মার অনুরোধও উপেক্ষা করতে পারে না। বড়মার কোনো সন্তান নেই। এজন্য টুকিটাকি কাজ করে দিতে হয়।
স্কুলে অনিকের বন্ধু মজিদ। সারাক্ষণ এক সাথে থাকে ওরা। একই বেঞ্চে বসে, এক সাথে খেলে, এক সাথে ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়ে পানি খেয়ে আসে। দরকার হলে টিচার্স রুমে যায়, সব জায়গায় ওদের এক সাথে দেখা যায়। সুখ-দুঃখ সব ভাগাভাগি করে নেয় ওরা। সবাই বলে মানিকজোড়।
হঠাৎ ক্লাসে শোরগোল। কে কয়টা আম খেয়েছে তার হিসাব দিচ্ছে সবাই।
– আমি কাল রাতে ৬টা আম খেয়েছি।
– আমি আজ সকালে ৩টা আম খেয়েছি।
– আমি কাল বিকেলে গাছে উঠে ৯টা আম খেয়েছি।
এভাবে সবাই বীরত্বের সাথে আম খাওয়ার গল্প করছে। অনিক জানালো সে রাতে দুধ দিয়ে দুটো আম খেয়েছে। এরপর মজিদের পালা।
– আমাদের তো আম গাছ নেই। আব্বু পরশুদিন তিন কেজি আম এনেছিল। ঐ দিনই শেষ।
মজিদের মুখটা শুকনা। দেখে খুব খারাপ লাগলো অনিকের। একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল অনিক। কারো মন খারাপ দেখলেই চোখে জল চলে আসে তার। বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে।
শেষ ক্লাসের আগেই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বের হয় অনিক। পথ আগলে দাঁড়ায় মজিদ।
– কই যাস অনিক?
– আমার একটু কাজ আছে, বাড়ি যাচ্ছি। তুই মনযোগ দিয়ে ক্লাস কর। আমি পরে তোর কাছ থেকে শুনে নেব।
এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসে অনিক। জামা-কাপড় পরিবর্তন করে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সেই লুকিয়ে রাখা আম তিনটা বের করে। লাল টুকটুকে সিঁদুরে আম। পেকে টসটস করছে। লুঙ্গির কোঁচার মধ্যে আম তিনটা নিয়ে বের হয়ে যায়। পেছন থেকে মা ডেকে ওঠে- এখন আবার কই যাস, ভাত বাড়লাম তো…।
– এখনই আসছি মা। ভাত ঢেকে রাখো।
– এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না। এই দুপুর রোদে তোর কোন মহান কাজ পড়লো শুনি?
মায়ের কথার জবাব না দিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলে যায় অনিক। মাটির প্রশস্ত রাস্তার পাশে পাকুড় গাছের ছায়াতে বসে থাকে সে। মজিদ এই রাস্তা দিয়েই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে। এই পর্যন্ত অনিক ও মজিদ দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে প্রতিদিন আসে। এরপর অনিক বাড়ি ঢুকে গেলে আরেকটু হেঁটে পরের পাড়ায় যেতে হয় মজিদকে।
অনিক বসে আছে মজিদের জন্য। একটু পরেই দেখা গেল মজিদ ক্লান্ত শরীরে একা একা হেঁটে আসছে। অনিক উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।
– তুই এখানে কী করিস?
– তোর সাথে দেখা করবো তাই বসে ছিলাম।
– হুম.. তুই শুধু শুধু আমাকে রেখে চলে এলি। পরের ক্লাস তো হয়নি। স্যার ছুটিতে।
– ও তাই? আচ্ছা যাই হোক, এই আমগুলো তোর জন্য। বাসায় গিয়ে মজা করে খাবি। আমাদের তো অনেক গাছ আছে।
মজিদ কী বলবে ভাষা খুঁজে পায় না। ঠোঁটটা একটু কেঁপে ওঠে। চোখের কোণায় একটু জলও এসে টলটল করতে থাকে। আনন্দের জল।
– এবার তবে বাসায় যা, বলে বাড়ির পথে এক দৌড় দেয় অনিক।
বাড়িতে ঢোকার আগেই বড়মার সাথে দেখা।
– সকালে এত পরিশ্রম করে আম তিনটা পেলি, কই নিজে মজা করে খাবি, তা না, বন্ধুকে দিয়ে দিলি?
অনিক বড়মাকে কিছুই বলে না। কিন্তু তার মন এখন অন্যরকম আনন্দে ভাসছে। নিজে খাওয়ার চেয়ে অন্যকে দিতে এত আনন্দ সে আগে ভাবেনি।
বাড়িতে ঢুকে খেতে বসে অনিক। একটু পরেই বড়মা এক ঝাঁকা আম নিয়ে হাজির। লাল টুকটুকে আম।
– এই নে, তোর জন্য এগুলো। তোর মনটা অনেক বড় রে বাবা। আমাদের মন অতো বড় নয়, এজন্য কাজ করিয়ে নিয়ে তবেই তোকে আম দেই। এখন থেকে যত আম খাওয়ার দরকার হবে, তুই বাড়িতে গিয়ে খাবি।
অনিক কী বলবে বুঝতে পারে না, উঠে এসে বড়মাকে জড়িয়ে ধরে।