‘শাড়ি’ লেখা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়

56

বাংলাদেশের একজন লেখক ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি লেখা নিয়ে দেশটির সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক শুরু হয়েছে। শাড়ি নিয়ে দেশের একটি বাংলা পত্রিকায় গত ৩০ অগাস্ট তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
সেখানে তিনি শাড়ির সঙ্গে বাঙালি নারীর শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু তার এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
অনেকে এই লেখাটিকে নারী বিদ্বেষী, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আর বর্ণবাদী বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে অনেকে এই লেখাটির পক্ষেও তাদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় তার ওই লেখাটি শুরু হয়েছে এইভাবে, শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথবা শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্মত, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক।’
সেখানে শাড়ি কিভাবে মেয়েদের শরীরের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে, শাড়ির সঙ্গে পশ্চিমা বা অন্যান্য পোশাকে মেয়েদের দেখতে কেমন দেখায় তার তুলনা এবং মেয়েদের শারীরিক গঠনের সঙ্গে শাড়ির সম্পর্ক, ইত্যাদি নানা বিষয় এসেছে।
তিনি লিখেছেন, আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার নারী শরীরেই কেবল শাড়িতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রিয়দর্শিনী সুকুমারী তন্বীরা বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতে যেখানকারই হোক।
আরো লিখেছেন, ‘শাড়ি একটা রহস্যময় পোশাক। নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে।’
আর শেষটা হয়েছে এইভাবে, ‘আমার মনে হয়, এ রকম একটা অপরূপ পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি মেয়েরা সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি।’
লেখাটি প্রকাশের পর থেকেই বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে তুমুল ঝড় চলছে।
অনিন্দিতা সেঁজুতি তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘ভদ্র ভাষায় সম্মানের সাথে বলতে গেলে দুঃখজনক লেখা! পুরো লেখায় বাঙালি নারীর বডি শেমিং করে গেছেন! সম্পূর্ণ সেক্সিস্ট লেখা!! শাড়ি কেউ ঝেঁটিয়ে বিদায়ও করেনি। এখনকার ব্যস্ত জীবনে মানুষ নিজ স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পোশাক পড়ে।’
জাহান সুলতানা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি ফুটে ওঠার একটা মানদন্ড কি পাঁচ ফুট চার ইঞ্চ উচ্চতা? যাই পড়ুক, তাকে সুন্দর লাগতে হবে কেনো। কেনো? সুন্দর লাগার জন্য বাঙালি নারীকে শাড়িই পরতে হবে। কেনো? মেয়েদের জন্য সৌন্দর্যটাই সবকিছু, এসব কিছু যদি পাশের বাড়ির সংকীর্ণমনা স্বল্প পড়ুয়া ভাবী বলেন, কানে লাগে না, কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মতো একজন ব্যক্তিত্ব দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে সরকারি না হলেও যখন অনেকটা এভাবেই শোনার মত করে বিষয়গুলো লিখেন, তখন ভীষণ অবাক হতে হয় বৈকি!’
বেসরকারি চাকরিজীবী জেসমিন চৌধুরী বলছেন, ‘আমি এক সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম, স্যারকে আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে দেখে এসেছি। কিন্তু তিনি নারীদের এভাবে দেখেন, এটাই আমাকে সবচেয়ে আহত করেছে। এটা তো নারীকে একজন মানুষ হিসাবে দেখা, পুরুষের সমান হিসাবে দেখা হলো না।’
যারা এই লেখার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন, তাদের বেশিরভাগই নারী। তাদের বেশিরভাগই লেখাটিকে অপমানজনক বলে মনে করছেন।
যেখানে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় নানাভাবে নারী শরীর ও সৌন্দর্যের বর্ণনা এসেছে, সেখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা নিয়ে এতো বিতর্ক কেন?
এ প্রসঙ্গে নারী অধিকার কর্মী ফেরদৌস আরা রুমি বলছেন, এখন সবার জন্যই প্রতিবাদের একটি জায়গা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম, যেখানে যেকোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়েই কিন্তু আলোচনা হয়। তার লেখাটা এখন এসেছে বলেই আলোচনায় বেশি। ওই লেখার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে নারীদের আপত্তি রয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যা তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
এই লেখাটায় তিনি যতটা সাহিত্যের বর্ণনার জায়গা থেকে লিখেছেন, তার চেয়ে নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসাবে বেশি দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। পুরো লেখায় নারীদের একেবারেই যৌন বস্তু হিসাবে দেখা হয়েছে, সেভাবে রগরগে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘শুধু নারীদের বন্দনা থাকলে হয়তো সবাই এতটা আপত্তি করতো না। কিন্তু লেখায় বাঙালি নারীদের নানাভাবে নারীদের হেয় করা হয়েছে। বাঙালি নারীদের উচ্চতা বেশি নয়, তাদের শাড়ি পড়ে সুন্দর হতে হবে, পাশ্চাত্য পোশাক পড়ে হাস্যকর তৃপ্তি পাচ্ছে, মেকআপ করতে হবে, অন্যদের কাছে যেন নারীর শরীর তুলে ধরাই কাজ, এরকম অনেক অপমানজনক বক্তব্য লেখায় রয়েছে।
অনেকে তাদের শাড়ি পড়া ছবিও আপলোড করেছেন। কেউ কেউ শাড়ির ছবির সঙ্গে লিখেছেন, কাউকে দেখাতে বা সুন্দর প্রমাণের জন্য নয়, ভালো লাগে বলে শাড়ি পড়ি।
তবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি নিয়ে এই লেখার পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন কেউ কেউ।
যেমন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নানা সামাজিক কাজের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে গোলাম রাব্বানি ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, একটি লেখার মাপকাঠিতে একজন মানুষের গোটা জীবনের অর্জনকে আপনি খারিজ করে দিতে পারেন না।
শংকর মৈত্র তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমিও মনে করি শাড়িতে বাঙালি নারীর যে রূপ ফুটে ওঠে, অন্য কোনো পোশাকে তেমনটি হয় না। নারীর শাড়ি আর পুরুষের লুঙ্গি। অসাধারণ কম্বিনেশন।’
আনিস আলমগীর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এখানে সমস্যা কোথায়? মাঝখানে নারীর রূপ সৌন্দর্য বর্ণনা? তিনি তো একজন সাহিত্যিক। শিক্ষকও। একজন সাহিত্যিক নারীর রূপ-সৌন্দর্যকে যেভাবে বর্ণনা করেন আমজনতার বর্ণনা থেকে তা তো ভিন্ন হতেই পারে। নাকি শিক্ষক হয়েছেন বলে উনি নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারবেন না!’
লেখাটির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে সাহিত্যিক ব্রাত্য রাইসু লিখেছেন, ‘যেই লোক সৌন্দর্যে বিশ্বাস করে না তারে কেউ জোর করতে যাবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু সৌন্দর্যে আপনার অবিশ্বাসের কারণে যিনি সুন্দরে বিশ্বাস করেন তিনি এর দ্বারা কোনো রেসিজম করেন না। ফলে বেটে মেয়েদের চাইতে লম্বা মেয়েরা অধিক সুন্দর, এই দেশে। বেশি লম্বা হইলে আবার সুন্দর না। আপনার সোসাইটি এই রকমই মনে করে।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই লেখার পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই সাহিত্য, সংস্কৃতি বা সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত।
বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বর্তমানে ব্রিটেনে অবস্থান করছেন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সাথে কথা বলার পরামর্শ দেয়া হয়।
অধ্যাপক সায়ীদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অধ্যাপক সায়ীদ ব্যক্তিগত সফরে ব্রিটেনে আছেন। এসময় তিনি ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গায় যাবেন। আগামী ১৬ই সেপ্টেম্বরের পরে অধ্যাপক সায়ীদ দেশে ফিরবেন বলে জানান তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা।