শান্তির বিশ্ব গড়তে ত্যাগের পথে আসার আহব্বান

80

হাজারো আহলে বায়তপ্রেমী সুন্নি উলামা ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে ১০ দিনব্যাপী ৩৪তম আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল দেশ ও বিশ্ববাসীর শান্তি-সমৃদ্ধি কামনায় আখেরি মুনাজাতের মধ্যদিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে শেষ হয়েছে।
মাহফিলের শেষ দিনে সিরিয়া ইয়েমেন ইরাক কাশ্মীরসহ দেশে দেশে নিরীহ মানুষের ওপর চলা নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ থামাতে জাতিসংঘ, ওআইসি ও আরবলীগসহ বিশ্ব সংস্থাগুলোকে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ, নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে স্বদেশে পূর্ণ নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ, রোহিঙ্গাদের মুক্তিসনদ হিসেবে চিহ্নিত কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন, হযরত ইমাম হোসাইনসহ (রা.) শাহাদাতে কারবালা ও নবী পরিবারের ত্যাগের ঘটনা সকল স্তরের পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন এবং সংঘাত-সহিংসতা ও হানাহানিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ মানবিক বিশ্ব গড়তে বিশ্ব নেতৃত্বকে ত্যাগের পথে আসতে আহব্বান জানান দেশি-বিদেশি আলোচক ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ।
পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক বক্তা আল্লামা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকী (র.) হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে চিহ্নিত খুনিদের বিচার করে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
মাহফিলের সমাপনী দিনে সভাপতিত্ব করেন মাইজভান্ডার দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীর শাহসূফি মাওলানা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল হাসানী (ম.জি.আ)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
বিদেশি আলোচক ছিলেন ইরাক বাগদাদের বড়পীর শেখ সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানির (র.) বংশধর শাহ্ সূফি আল্লামা সৈয়দ আফিফ আব্দুল কাদের মনসুর আল-জিলানি আল-বাগদাদী, ভারত কাসওয়াসা দারবার শরিফের সাজ্জাদানশিন আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ আল-আশরাফি আল-জিলানি ও মিশরের ক্বারী মুহাম্মদ রিদওয়ান গোম্মাহ ইউনুছ।
প্রধান অতিথি ব্যারিস্টার নওফেল বলেন, কারবালায় দ্বীন-ইসলামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন আহলে বায়তে রাসুল (দ.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)। আজও ইয়াজিদির দোসররা থেমে নেই। কিন্তু যুগে যুগে ইয়াজিদিরা ধ্বংস হয়েছে। ইয়াজিদি খারেজিরা সুন্নিয়তের শত্রæ। যারা সুন্নিয়তকে ধ্বংস করতে চায় সম্মিলিত শক্তি দিয়ে আমরা তাদের প্রতিহত করবো। সুন্নিয়তের শত্রুদেরকে আমরা কিছুতেই রেহাই দেবো না- এই হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল হাসানী বলেন, নবী পরিবার তথা আহলে বায়তে রাসূলের (দ.) সীমাহীন ত্যাগের মধ্যদিয়ে আমরা দ্বীন-ইসলামের নিয়ামত লাভ করেছি। তাই, আহলে বায়তে রাসূলের (দ.) স্মরণের পাশাপাশি তাঁদের জীবনাদর্শ অনুসরণে আমরা নাজাতের ভাগিদার হতে পারি। শাহাদাতে কারবালার চেতনা ও দর্শন হচ্ছে ত্যাগ। দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ছাড়া নাজাত মিলবে না- এটাই হযরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শিক্ষা।
ইরাকের আল্লামা সৈয়দ আফিফ জিলানি বলেন, কারবালা ট্র্যাজিডি আমাদের কাঁদায়। হৃদয় হাহাকার করে ওঠে আমাদের। সেদিন অবুঝ সন্তান ইমাম আলী আসগর ও আলী আকবরসহ নবী পরিবারের ওপর যে জঘন্য নির্মমতা-বর্বরতা চালিয়েছে ইয়াজিদি গোষ্ঠী, তা জেনে আমারা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। তাই কারবালার চেতনায় দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের নিবেদিত হতে হবে।
আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ আল জিলানি বলেন, ইসলামের বুনিয়াদ প্রিয় নবী (দ.) ও আহলে বায়তে রাসূলের (দ.) ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত। সকল ইবাদত আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার পূূর্বশর্ত হচ্ছে প্রিয় নবীর (দ.) ওপর দরুদ পড়া। যে ইবাদতের আগে ও পরে দরুদ পড়া হয়, তা নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। তাই আমাদেরকে বেশি বেশি করে প্রিয় নবীর (দ.) ওপর দরুদ পড়তে হবে। এতে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রিয় নবীর (দ.) নৈকট্যধন্য হতে পারি।
মাহফিলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন জমিয়তুল ফালাহ শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চেয়ারম্যান এবং পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। কুরআন মজিদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ আসে। পরিশ্রম ও ত্যাগ ছাড়া সুখ আসে না। জীবনে সুখ-শান্তি চাইলে অহংকার, হিংসা ও পরনিন্দা করার অভ্যাস বর্জন করতে হবে। আমরা কারবালার শোককে শক্তিতে পরিণত করবো। আমরা দুঃখকে আনন্দে পরিণত করবো, সর্বদা আল্লাহর জিকির করবো, সব সময় সুখে-দুঃখে আল্লাহর শোকর গুজারি করবো, জীবন সঙ্গিনীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবো, সুশিক্ষা দিয়ে সন্তানদেরকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলবো- এ হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ।
তিনি বলেন, শুধু টাকা-পয়সা খরচ করে সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। শাসন-অনুশাসন ও ভালোবাসা দিয়ে সন্তানদের সৎ আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। ইনশাআল্লাহ আপনার সন্তান কখনো বিপথগামী হবে না।
তিনি ১০ দিনব্যাপী শাহাদাতে কারবালা মাহফিলে অংশগ্রহণকারী ও সহযোগিতাকারীদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
কারবালা পরবর্তী মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন জমিয়তুল ফালাহর খতিব আল্লামা সৈয়দ আবু তালেব মুহাম্মদ আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, কারবালার ঘটনা নবী পরিবারের ওপর আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষা ছিল। তাতে তাঁরা উত্তীর্ণ হন। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) দুনিয়ার কোনো রাজা বাদশা ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রিয় নবীর (দ.) যোগ্য প্রতিনিধি।
নবী করিম (দ.) এর ইলমে গায়েব ও ইমাম হোসাইনের (রা) শাহাদাত বিষয়ে আলোচানা করেন চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. আল্লামা এ কে এম মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সুন্নিয়তের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন বলেই নির্মমভাবে খুন হন আল্লামা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকী (র.)। পাঁচ বছর পার হলেও এখনও খুনিদের বিচার শুরু হয়নি। এটি খুবই বেদনাদায়ক। এতে সুন্নিজনতা আজ ক্ষুব্ধ।
মাহফিলে বক্তব্য রাখেন ড. মাওলানা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আজহারি। আলহাজ মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, ড. মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ ও অধ্যাপক মাওলানা জিয়াউল হক রিজভির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মাহফিলে অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুচ ছালাম, পিএইচপি ফ্যামিলির ডাইরেক্টর মোহাম্মদ আলী হোসেন ও মোহাম্মদ আকতার পারভেজ, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান আলহাজ পেয়ার মোহাম্মদ, আলহাজ হাসান মাহমুদ চৌধুরী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার উপাধ্যক্ষ ড. মাওলানা আবু তৈয়্যব মুহাম্মদ লিয়াকত আলী, ডেপুটি এটার্নি জেনারেল আলহাজ আবুল হাশেম, ব্যারিস্টার আবু সাঈদ মুহাম্মদ কাসেম, মাসুদুর রহমান আশরাফি, সাবেক কমিশনার বদিউল আলম, সৈয়দ সেহাব উদ্দীন আলম, অধ্যক্ষ আল্লামা তৈয়ব আলী, মাওলানা হাফেজ আহমদুল হক, মাওলানা হাফেজ জালাল উদ্দিন, হযরত মোহছেন আউলিয়া দরগাহ শরীফের খাদেম আলহাজ মাওলানা শামসুল ইসলাম, সংগঠক দিদারুল আলম চৌধুরী।
কুরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াত করেন আন্তর্জাতিক ক্বারী শাইখ আহমাদ বিন ইউসুফ আল আজহারী। হামদ ও নাতে রাসূল (দ) পরিবেশন করেন শায়ের মাওলানা মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন।
শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল মোস্তফা, খোরশেদুর রহমান, আনোয়ারুল হক, সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল লতিফ, অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমদ, আবদুল হাই মাসুম, মোহাম্মদ দিলশাদ আহমদ, ছালামত উল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক, জাফর আহমেদ সাওদাগর, আবুল মনসুর শিকদার, মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, এসএম শফিসহ জামেয়া আহমদিয়ার আলেমবৃন্দ, গাউছিয়া কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন সাজ্জাদানশিনবৃন্দ মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন।
পরে সালাতু ছালাম শেষে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় মোনাজাত করা হয়। পরে পরিবেশিত হয় তাবরুক। বিজ্ঞপ্তি