লাগামহীন স্বর্ণ চোরাচালান

29

করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে লকডাউন পরিস্থিতি কাটিয়ে আকাশপথে দুবাইসহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি রুটে ফ্লাইট চলাচল পুনরায় শুরু হতেই শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণবারের চোরাচালান লাগামহীনভাবে বেড়েছে। মাঝখানে গত অক্টোবরে ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধ উপায়ে শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণের বার আমদানি হঠাৎ বাড়লেও তার কয়েকগুণ বেশি স্বর্ণ চোরাপথেই বিমানবন্দর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ওই মাসের প্রথম ২০ দিনেই বিমানবন্দর কাস্টমসে বিদেশফেরত যাত্রীরা কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করে রেকর্ড পাঁচশ’ ১০টি স্বর্ণের বার ছাড় করিয়ে নিলেও গত মাসে আবার তা কমেছে। উল্টো গত নভেম্বর মাসে পুলিশ নগরীর স্টেশন রোড থেকে পক্ষকালের ব্যবধানে ২২টি অবৈধ স্বর্ণের বার ও কিছু অলঙ্কারসহ রেয়াজউদ্দিন বাজার ও হাজারী লেনভিত্তিক স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর পেরিয়ে স্বর্ণ বার নিয়ে আসা হয় প্রধানত নগরীর হাজারী লেন ও রেয়াজউদ্দিন বাজারভিত্তিক চোরাকারবারি চক্রের কাছে। এরপর সেখান থেকে বাহক মারফত তা ঢাকা হয়ে ভারত সীমান্তের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে চোরাচালান চক্রের সাথে জড়িত অন্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১০ নভেম্বর নগরীর স্টেশন রোড এলাকা থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশ আটটি অবৈধ স্বর্ণের বারসহ মোট ৮৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ জোসেফ উদ্দিন রুমন (২৭) নামে পাচারকারী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তিনি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তর পদুয়ার দক্ষিণ পাড়ার এলাকার মো. জহির আহমদের ছেলে। জব্দ করা এসব স্বর্ণের অনুমানিক বাজার মূল্য ৬০ লাখ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জোসেফ পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি চোরাকারবারি চক্রের হয়ে স্বর্ণগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। এরপর গত ২৭ নভেম্বর নতুন রেল স্টেশন এলাকায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে দুইশ’ ২১ ভরি ওজনের ১৪ টি স্বর্ণের বারসহ উত্তম সেন (৩৫) নামে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের আরেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তার গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ব্রাহ্মণঘাটায় হলেও থাকেন পতেঙ্গা মহাজনঘাটা এলাকায়।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, উত্তম সেনের দেহ তল্লাশি করে কালো রংয়ের স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় দুইশ’ ২১ ভরি ওজনের ১৪টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। তিনি তার প্যান্টের সাথে পরা বেল্টের ভেতরে কৌশলে স্বর্ণের বারগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এসব স্বর্ণের বার তাকে নগরীর হাজারী লেনের সনজিত ধর (৩৮) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী ঢাকায় পৌঁছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানান। এ বিষয়ে উত্তম ও সনজিতকে আসামি করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে থানায় মামলা করা হয়েছে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গত অক্টোবর মাসের প্রথম ২০ দিনেই পাঁচশ’ ১০টি স্বর্ণের বার বৈধ উপায়ে শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় করিয়ে নিয়ে বার যাত্রীরা। এসব স্বর্ণের বারের ওজন প্রায় ৫৯ কেজি। এ থেকে শুল্কবাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঘোষণা দিয়ে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে নয় কেজির বেশি স্বর্ণের বার এনেছিলেন যাত্রীরা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে শাহ আমানত বিমানবন্দরে একশ’ চার কেজির বেশি স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে খালাস করেছেন যাত্রীরা। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইফেরত যাত্রীরাই বিমানবন্দর দিয়ে বেশিরভাগ স্বর্ণের বার নিয়ে এসেছেন।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, করোনার লকডাউন পরবর্তী পরিস্থিতিতে বর্তমানে শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে দুবাই রুটে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ বিমানের তিনটি ফ্লাইট চলাচল করে। এসব ফ্লাইটে করেই গত অক্টোবর মাসের প্রথম ১৫ দিনেই বৈধ ও অবৈধ পথে স্বর্ণের বার আনা হয়েছে সাতশ’ ৩৬টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর কাস্টমসে প্রতিটি দশ ভরি বা ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বারের বিপরীতে ২০ হাজার দুইশ’ টাকা করে শুল্ক পরিশোধ করে ছাড় করা হয়েছে সর্বমোট চারশ’ ৮৪ পিস স্বর্ণের বার। আর অবৈধ পথে আনা দু’টি চালানে জব্দ করা হয়েছে দুইশ’ ৫২ পিস স্বর্ণের বার। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। যদিও তার কয়েকগুণ বেশি স্বর্ণ চোরাপথে বিমানবন্দর পেরিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত পয়লা অক্টোবর বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ৮২ পিস স্বর্ণের বার জব্দের পরের শিডিউলে ২৬ পিস স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে বৈধ করা হয়। সবশেষ ১৫ অক্টোবর একশ’ ৬০ পিস অবৈধ বার জব্দ হওয়ার দিনই শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় করা হয়েছে আরও একশ’ ১৫ পিস স্বর্ণের বার।
মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় থামছে না চোরাচালান ঃ চলতি বছরের ১১ জুন চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বর্ণবার চোরাচালান ও মুদ্রা পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আবু আহম্মদকে প্রধান আসামি করে নগরীর কোতোয়ালী থানায় মুদ্রা পাচার আইনে সর্বমোট ২০ জনকে আসামি করে ঢাকা সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম এন্ড স্কোয়াড অর্গানাইজড ক্রাইমের এসআই মো. হারুন উর রশীদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মুদ্রাপাচার আইনের ওই মামলার এজাহরে বিগত ১২ বছরে এই চক্র স্বর্ণবার চোরাচালান ও হুন্ডির কারবারে সাড়ে চারশ’ কোটি টাকা লেনদেন করার তথ্য পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে নগরী ও জেলার বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। চলতি বছরের ১৩ জুন গ্রেপ্তারকৃত ১২ আসামি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির ছয়টি পৃথক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের অন্যতম টিটু ধর হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে জামিন আবেদন করলে চলতি বছরের গত ১১ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হয়। ওই জামিন আদেশ কারাগারে এসে পৌঁছানোর পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। বিষয়টি নজরে এলে হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চের দেয়া জামিন আদেশ স্থগিত করতে আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গ্রহণ করে টিটু ধরের জামিন আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে তাকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তবে গত ১৯ নভেম্বর মামলার ধার্য তারিখে আসামি টিটু ধর নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। আদালতে তার পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী নয়ন কুমার ধর আসামি হাজির হওয়ার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করলেও আদালত শুনানি শেষে তা খারিজ করে দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই মামলায় উচ্চ আদালতের জামিন আদেশে কারামুক্ত অপর দুই আসামি ওবায়দুল আকবর ও রুবেল চক্রবর্তীও নি¤œ আদালতে হাজির হননি। অপর দুই আসামি আনোয়ারার বাসিন্দা সাগর মহাজন ও ঢাকার ওয়ারী এলাকার এমতিয়াজ হোসেনের জামিন আদেশ আপিল বিভাগে স্থগিত হওয়ার নথিপত্র কারাগারে চলে আসায় তারা শেষপর্যন্ত মুক্তি পাননি।
মুদ্রাপাচার বা মানি লন্ডারিং আইনের এ মামলার এজাহারভুক্ত ২০ জনের মধ্যে প্রধান আসামি নগরীর হিলভিউ আবাসিকের আবু আহম্মদ ছাড়াও ফটিকছড়ির ইকবাল মোহাম্মদ নেজাম, লোহাগাড়ার এস এম আসিফুর রহমান, ফটিকছড়ির মো. রফিক, মিনহাজ উদ্দিন, ঢাকার পান্নিতলার দীনবন্ধু সরকার, হাটহাজারীর আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের শাহজাহান এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন। অপর আসামিদের মধ্যে ফটিকছড়ির আবু রাশেদ ও জিয়া উদ্দিন বাবলু, চন্দনাইশের ইমরানুল হক মো. কফিল চৌধুরী, লোহাগাড়ার মোহাম্মদ আলী, ফরিদুল আলম ও মোহাম্মদ এরশাদুল আলম এবং মো. হাসান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও জামিনে মুক্তির পর উধাও হয়ে গেছেন নগরীর হাজারীলেনের টিটু ধর ও রুবেল চক্রবর্তী এবং ফটিকছড়ির ওবায়দুল আকবর। আদালতে ১২ আসামির দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বর্ণ চোরাচালান ও মুদ্রাপাচারকারী এই চক্রের সাথে আরও ছয়জনের নাম বেরিয়ে এসেছে।