রোম পোড়ার সময় নিরো কী বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?

60

রোমান সম্রাট নিরো ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং পাগলাটে শাসকদের একজন হিসেবে পরিচিত। বলা হয় যে তিনি তার মাকে হত্যা করেছেন। হত্যা করেছেন তার সৎ ভাই ও স্ত্রীদেরকেও। খ্রিস্টানদের উপর চালিয়েছেন অকথ্য নিপীড়ন। সম্রাট নিরো ছিলেন অত্যন্ত বেহিসাবি। বিশাল আকারের একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে গিয়ে তার পেছনে উড়িয়েছেন অঢেল অর্থ।
একই সাথে তিনি খেলাধুলারও আয়োজন করতেন। আয়োজন করতেন রথ দৌড় প্রতিযোগিতা। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে অভিনয়ও করতেন তিনি এবং নিজেকে দাবি করতেন একজন শিল্পী হিসেবে।
ইতিহাসে বলা হয়, রোম নগরী যখন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল তখন সেদিকে তার কোন ভ্রæক্ষেপও ছিল না। বরং সেসময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন নিরো। ইতিহাসের এই ঘটনাটির কথা আজকের দিনেও উল্লেখ করা হয়।
স্বৈরশাসকরা যখন জনগণের বিক্ষোভ প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্যাহত রাখেন তখন নিরোর সাথে তুলনা করে বলা হয়, ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।’
নিরোর এই ভীতিকর ইমেজ কি আসলেই সত্য? ইতিহাসের কুখ্যাত এই রোমান শাসক সম্পর্কে এখানে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা হলো:
মাত্র ১৬ বছর বয়সে সম্রাট হন নিরো। তিনি ক্ষমতায় আসেন ৫৪ খৃস্টাব্দে। সে সময় রোমান সাম্রাজ্য খুব বিস্তৃত ছিল। এই সাম্রাজ্য ছিল পশ্চিমে স্পেন থেকে উত্তরে ব্রিটেন পর্যন্ত। আর পূর্ব দিকে ছিল সিরিয়া।
সম্্রাট নিরোর শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছরকে দেখা হয় রোমান জনগণের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে। সেনেটের হাতে তিনি অনেক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রোমের সেনাবাহিনীকে এক পাশে সরিয়ে রাখেন এবং খেলাধুলার মতো নানা ধরনের প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণ লোকজনের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন।
কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। ভয়ঙ্কর সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা তার এই সাফল্যকে অচিরেই ম্লান করে দেয়। এই নিষ্ঠুরতা তার শাসনকালের বাকিটা সময়জুড়েই অব্যাহত ছিল।
মায়ের কারণে সম্রাট : বলা হয় নিরোর ক্ষমতালোভী মা-ই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। এটাই ছিল তার সম্রাট হওয়ার পেছনে মূল কারণ। নিরোর মা এগ্রিপিনা তার চাচা সম্রাট ক্লডিয়াসকে বিয়ে করেন। পরে চাচাতো বোনের সাথে নিরোর বিয়েরও ব্যবস্থা করেন তিনি। এটা তিনি করেছিলেন পরিবারের ভেতরে তার ছেলে নিরোর ক্ষমতাকে আরো পোক্ত করার জন্য। সম্রাট ক্লডিয়াসের পুত্র সস্তান থাকা সত্বেও মা এগ্রিপিনা তার ছেলেকেই সম্রাট ক্লডিয়াসের উত্তরসূরি বানাতে চেয়েছিলেন।
বলা হয় যে এগ্রিপিনা সম্রাট ক্লডিয়াসকে এক প্লেট বিষাক্ত মাশরুম খাইয়ে তাকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এই তথ্য কতোটা সত্য সেটা যাচাই করে দেখার কোন উপায় নেই।
মাকে হত্যা : নিরোর ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম দিকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য উপদেষ্টা ছিলেন তার মা এগ্রিপিনা। সেকারণে রোমান মুদ্রায় তার ছবির সাথে এগ্রিপিনার মুখের ছবিও খোদাই করা ছিল। কিন্তু নিরো পরে আরো বেশি ক্ষমতা ও স্বাধীনতার জন্যে তার মাকেও হত্যা করেন।
মাকে হত্যার জন্যে নিরোর প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। সমুদ্রের তীরে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন নিরো যেখানে তিনি তাকে মাকেও আমন্ত্রণ জানান। তারপর তাকে এমন একটি জাহাজে করে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন তিনিযেটি ভেঙে ডুবে যাওয়ার মতো করেই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই চেষ্টায় তার মা বেঁচে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি মায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলেন এবং তাকে হত্যা করার জন্যে লোক পাঠান।
রোমে আগুন ও নিরো : ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডে ৬৪ খৃস্টাব্দে রোমের বেশিরভাগ এলাকা পুড়ে গিয়েছিল। একটা গুজব আছে যে নিরোই নাকি এই আগুনটা লাগিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরে এও দাবী করা হয় যে রোম নগরী যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন।
এই তথ্য সঠিক হতে পারে না। কারণ রোমান সাম্রাজ্যের আমলে বেহালার অস্তিত্ব ছিল না। তবে নিরো বীণাজাতীয় বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো উপভোগ করতেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন রোমের অগ্নিকান্ডের জন্যে নিরো দায়ী নন। কারণ এই আগুনে নিরোর নিজের প্রাসাদও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, অগ্নিকান্ডের পর তিনি রোম নগরীর বড় ধরনের উন্নতিও সাধন করেছিলেন।
বলির পাঁঠা খ্রিস্টান : নিরো অভিযোগ করেন যে খ্রিস্টানরাই এই আগুন লাগিয়েছিল। এটা তিনি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। ওই সময়ে রোমে খ্রিানদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তারা ছিল প্রান্তিক এবং অজনপ্রিয়। বলা হয়, শহরে আগুন দেওয়ার শাস্তি হিসেবে খ্রিস্টানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন নিরো। তাদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, বন্য জন্তু দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়, এবং তাদের শরীরে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এখানেই শেষ নয়, এসব শাস্তি দেওয়ার সময় উৎসবও করা হতো। লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হতো এসব প্রত্যক্ষ করার জন্য।
নিরোর বিশাল প্রাসাদ : ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডের পর নিরো দুটো পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল একটি প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। বলা হয় সেখানে সোনার তৈরি একটি ঘর ছিল। ওই ঘরের ভেতরে ছিল ঘূর্ণায়মান টেবিল এবং ঘরের দেওয়ালগুলোতে পাইপ বসানো ছিল যা দিয়ে সুগন্ধি প্রবাহিত হতো। এ প্রাসাদ নির্মাণের পেছনে ব্যয় করা হয়েছিল প্রচুর অর্থ। কিন্তু এই কাজ কখনোই শেষ হয়নি।
গোটা শহর যখন আগুনের ধ্বংসস্ত‚প থেকে পুনরায় জেগে ওঠার চেষ্টা করছিল, তখন শহরের লোকজন দেখছিল তাদের সামনে এমন বিলাসবহুল একটি প্রাসাদ তৈরি করা হচ্ছে। তবে বলা হয় যে রোমের লোকজন যাতে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন সেজন্যে এই প্রাসাদটি খুলে দেওয়ার কথা ছিল।
স্ত্রী হত্যা : নিরোর প্রথম স্ত্রী ছিলেন ভিক্টোরিয়া। তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করান নিরো এবং শাস্তি হিসেবে তাকে নির্বাসনে পাঠান। তারপর তার পেছনে খুনি লেলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর নিরো পপ্পেয়াকে বিয়ে করেন। তার প্রেমেও পড়ে ছিলেন তিনি। পরে তিনি যখন গর্ভবতী হয়ে পড়েন তখন তার উপর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলেন। তাকে লাথি মেরে হত্যা করেন তিনি।
তার যে স্ত্রীকে তিনি হত্যা করেছিলেন, বলা হয়, মঞ্চে বসে বিয়োগাত্মক সঙ্গীত বাজানোর সময় তিনি তার মুখোশ পরে থাকতেন। এথেকে ধারণা করা হয় যে তিনি হয়তো অপরাধবোধ ও শোকে ভেঙে পড়েছিলেন।
অভিনেতা নিরো : নিরো থিয়েটার করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি বীণা জাতীয় বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন এবং মঞ্চে অভিনয়ও করতেন। এসব বিষয়ে একজন রোমান সম্রাটের আগ্রহকে খুব ভালোভাবে দেখেনি সেনেট। তারা মনে করতেন এটা খুবই লজ্জার ও মানহানিকর।
তারপরও নিরো থিয়েটারে অভিনয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্যে গ্রিসে এক বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন খেলাধুলাতেও অংশ নিতেন তিনি। বলা হয় যে ১০টি ঘোড়া টেনে নিয়ে যায় এরকম রথ চালনায় খুব দক্ষ ছিলেন তিনি।
নাটকীয় মৃত্যু : নিরোর বয়স ৩০ হতে হতেই তার বিরুদ্ধে বিরোধিতা চরমে পৌঁছায়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সেনেট তাকে জনগণের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। এর অর্থ হচ্ছে নিরোকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই তাকে হত্যা করা হবে।
এরপর নিরো মফস্বলের মতো একটি জায়গায় পালিয়ে গিয়ে সেখানকার একটি ভিলাতে আশ্রয় নেন। রক্ষীরা যখন তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন তিনি আত্মহত্যা করেন। বলা হয়, মারা যাবার সময় তিনি কোয়ালিস আর্টিফেক্স পেরেও বলে চিৎকার করছিলেন। এটা বলে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা পরিষ্কার নয়। কারণ এই কথার নানা রকমের অর্থ হতে পারে।
এর একটা হতে পারে- ‘আমার মৃত্যুর সময়ে আমি কী দারুণ এক শিল্পী, ‘আমার সাথে কী এক শিল্পীর মৃত্যু হচ্ছে’ অথবা ‘আমি একজন বণিকের মতো মারা যাচ্ছি।’ অর্থ যা-ই হোক না কেন মৃত্যুর আগে তার এই শেষ উচ্চারণ তার জীবনের মতোই নাটকীয় ছিল।