মানুষ কখন ও কেন কথা বলতে শিখলো?

119

আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম কবে কথা বলতে শিখেছিল? এখন যে হাজার হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলে সেগুলো কি ওই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই এসেছিল? এসব ভাষার ইতিহাস থেকে কি তার উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব? লেখক ও ভাষা-প্রেমিক মাইকেল রোজেন সেটাই অনুসন্ধান করে দেখছেন…
‘পৃথিবীতে মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা আছে, এই ভাষার কারণে আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছি।’ বলেছেন নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাগি টলারম্যান।
ভাষার মাধ্যমে এই যে ভাবের বিনিময়, কথার আদান প্রদান, সেটাকে দেখা হয় বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হিসেবে। সবকিছুকে বদলে দিয়েছে এই ভাষা। আর একারণেই মানুষ ভাষার উৎস সম্পর্কে জানতে দারুণ উৎসাহী।
‘জটিল যতো বিষয় আছে তার একটি এই ভাষা এবং এটিই আমাদের মানুষ বানিয়েছে।’ বলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব বিবর্তন বিভাগের শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী রবার্ট ফোলি।
বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ সাড়ে ছয় হাজারের মতো ভাষায় কথা বলে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা কোনটি? সবচেয়ে পুরনো ভাষার নাম জানতে চাইলে আমরা অনেকেই ভাবি ব্যাবিলনীয়, সংস্কৃত কিম্বা মিশরীয় ভাষার কথা।
কিন্তু অধ্যাপক টলারম্যান বলছেন, এসব ভাষা তার ধারে-কাছেও নেই। সাধারণত আমরা বলি যে ভাষা ছয় হাজার বছর পুরনো। কিন্তু ভাষার প্রকৃত উৎস যদি খুঁজে দেখতে হয় তাহলে অন্তত ৫০ হাজার বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে।
বহু ভাষাবিজ্ঞানী মনে করেন, ভাষার ইতিহাস আসলে এর চেয়েও পুরনো।
‘আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ভাষার উৎপত্তি পাঁচ লাখ বছর আগেও হতে পারে।’ বলেন অধ্যাপক টলারম্যান।
পৃথিবীতে যতো ভাষা আছে সেগুলোর চরিত্র আলাদা আলাদা হলেও ‘এটাও সম্ভব যে বর্তমানে সব ভাষাই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে।’ বলেন অধ্যাপক ফোলি।
জীববিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাসের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা ভাষা কবে শুরু হয়েছিল তার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। জিন-বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে আমরা কমবেশি সবাই এসেছি আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে।
ভাষার এই তালিকার বাইরেও হয়তো অন্যান্য ভাষাও থাকতে পারে, কিন্তু আজকের দিনে যেসব ভাষায় কথা বলতে শোনা যায় সেগুলোর সবই সম্ভবত একই ভাষা থেকেই বিবর্তিত হয়েছে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায় যে আমরা ঠিক কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিলাম।
অধ্যাপক ফোলি বলছেন, ‘কথা হচ্ছে একধরনের শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া। এটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই আমরা শব্দ তৈরি করে থাকি।’
এটা করার জন্যে শরীরের পেশীর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়। ‘আমাদের বক্ষ এবং উদরের মাঝখানে যে ঝিল্লির পর্দা সেটি অন্যদের থেকে আলাদা। আমাদের কাছাকাছি যে প্রাণী, অর্থাৎ বানর বা এইপ, যারা কথা বলতে পারে না, তাদের ঝিল্লির তুলনায় আমাদের ঝিল্লিতে নার্ভের সংখ্যা বহুগুণে বেশি।’
এসব নার্ভের অর্থ হচ্ছে ‘আমাদের স্পাইনাল কর্ড এইপের স্পাইনাল কর্ডের চেয়ে মোটা এবং আমাদের ভার্টিব্রাল কলামও একটু বেশি প্রশস্ত। নিয়েন্ডারথাল নামে আমাদের যে আত্মীয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যারা ছ’লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে বেঁচে ছিল, তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তাদের স্পাইনাল কলামও প্রশস্ত ছিল। কিন্তু আপনি যদি দশ লাখ বছর আগের হোমো ইরেক্টাসের দিকে তাকান, যারা মানবজাতির প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ, তাদের দেহে এরকম ছিল না। এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে মানুষ কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিল।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্মের রেকর্ডের বাইরেও জিন-বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে ভাষার বয়স জানা সম্ভব হচ্ছে।
‘এফওএক্সপিটু নামের একটি জিন আছে। স্তন্যপায়ী প্রায় সকল প্রাণীর শরীরেই আছে এই জিন। কিন্তু মানবদেহে যেটি আছে সেটি এর রূপান্তরিত জিন।’ বলেন অধ্যাপক ফোলি।
জিনের এই রূপান্তর গবেষণা করেও বোঝা যায় কেন মানুষ কথা বলতে পারে, কিন্তু শিম্পাঞ্জি পারে না। কথা বলা ও ভাষার বিকাশে এই জিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ যেসব মানুষের শরীরে এই জিনটি রূপান্তরিত অবস্থায় থাকে না, তাদের কথা বলতে অসুবিধা হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, এখনকার মানুষদের মতো নিয়েন্ডারথালদেরও এই এফওএক্সপিটু ধরনেরই জিন ছিল। এর ফলে ধারণা করা যায় যে তাদের মধ্যেও কোন না কোন ধরনের কথা বা ভাষা ছিল।
তবে তাদের সেই ভাষা সম্পূর্ণ এবং উন্নত ছিল কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।
অধ্যাপক টলারম্যান বলছেন, কথার সাথে ভাষার তফাৎ আছে। তবে কী কারণে কথা একসময় ভাষা হয়ে উঠে সেটা জিনগত তথ্যপ্রমাণ থেকে নির্ণয় করা কঠিন।
আদি-মানবের মাথার খুলির আকৃতি থেকে কি ভাষার উৎপত্তির সময় খুঁজে বের করা সম্ভব? অবশ্যই না।
সবচেয়ে সহজ কারণ হলো আমরা ঠিক জানি না যে একটি ভাষা তৈরির জন্যে কতো বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। ‘নিয়েন্ডারথালসের মস্তিষ্ক আমাদের চেয়েও বড় ছিল। কারণ প্রাণী হিসেবেও তারা বড় ছিল। – বলেন অধ্যাপক টলারম্যান।
আমরা যখন মানবজাতির শুরুর দিকের ভাষা নিয়ে কথা বলছি, আমরা কি বলতো পারবো তখন মানুষের মুখ থেকে প্রথম কোন শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল?
‘সৎ উত্তর হচ্ছে: আমাদের আসলে কোন ধারণাই নেই।’ বলেন প্রফেসর ফোলি।
মানব ইতিহাসের শুরুর দিকে যে শব্দগুলো চালু ছিল বলে ধারণা করা হয় সেগুলোর অর্থ হতে পারে ‘ঈগল’, ‘চিতা’ অথবা ‘দেখো’।
অনেকে মনে করেন, আমাদের পরিবেশের আশেপাশে সহজ ও সুনির্দিষ্ট কোন জিনিসই হয়তো মানুষের মুখ থেকে প্রথম এসেছিল।
আরেকটি তত্ত¡ হচ্ছে প্রথম দিককার শব্দগুলোর মধ্যে এমন শব্দগুলোই ছিল যেগুলো আমরা এখন সবসময় ব্যবহার করি। যেমন: ইশ, হেই, ওয়াও, থ্যাংকস, গুডবাই- এ ধরনের শব্দ।
এসব শব্দ প্রায় সব ভাষাতেই আছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে মিল হচ্ছে যে এসবের কোন সিনটেক্স বা ব্যাকরণ নেই।
খাওয়ার সময় ভাষা তৈরি হয়েছিল?
মানবজাতির শুরুতে কথা বলা শুরু হয়েছিল একে অপরকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণ করতে গিয়েও।
আমাদের পূর্বপুরুষরা বড় বড় শিকারি প্রাণীদের হাতে নিহত পশুর মৃতদেহ থেকে মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করতো।
‘হায়েনাদের হাতে নিহত পশুদের মরদেহ থেকে মাংস খেতে হলে আপনার সাথে আরো কিছু মানুষের প্রয়োজন হতো। কারণ এটা একটা বিপদজনক কাজ ছিল।’ বলেন অধ্যাপক টলারম্যান।
আপনি যখন খাবারের খোঁজে ঘর থেকে বের হলেন, একটা পশুর ভালো মৃতদেহও খুঁজে পেলেন এবং আপনার গ্রæপের লোকজনদের জানাতে চান যে আশেপাশেই ভালো খাবার আছে তখন তো একটা ভাষার দরকার হবে, – বলেন তিনি।
বিজ্ঞানীদের ধারণা খাদ্য গ্রহণের তাড়না এবং বেঁচে থাকার চেষ্টার কারণে মানুষের মধ্যে একে অপরকে জানানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একসাথে মিলে কাজ করার ক্ষমতা থেকেও ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা তৈরি হয়েছে। পরস্পরকে সহযোগিতা করাই এক্ষেত্রে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, বলেন অধ্যাপক ফোলি, বিশেষ করে জোটবদ্ধ হওয়া এবং চারপাশে কী হচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করা।
এই আড্ডা মারার মতো করে কথা বলার গুরুত্বও কম ছিল না। টুকটাক কথা বলা, পরচর্চা বা গসিপ এগুলো প্রতিদিনেরই অংশ, বলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইতিহাসবিদ ড. লরা রাইট।

বাড়ির কোন কোন জায়গায়
সবচেয়ে বেশি জীবাণু
বিবিসি বাংলা
বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে গিয়ে অনেকেই বেশি নজর দেন সেই জায়গাগুলোর দিকে- যেগুলো দেখতে ‘ময়লা’ দেখায়। পরিষ্কার করার সময় সেগুলোর ওপরই আগে হাত দেন তারা। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। পরিষ্কার করতে হবে বাড়ির সেই অংশগুলো- যেখান থেকে ক্ষতিকর মাইক্রোব বা অনুজীব ছড়ায়- তা যদি এমনিতে দেখতে পরিষ্কার দেখায় তা হলেও ।
এক জরিপে দেখা গেছে, হাত ধোয়া, কাপড় চোপড় এবং বাড়ির বিভিন্ন অংশ ঠিক সময়ে পরিষ্কার করা- এগুলোই বাড়িতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষার জন্য আসল দরকারি জিনিস। কিন্তু প্রতি চারজনের একজনই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না।


বাড়িতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশন রাখতে কি করা উচিত? প্রথমে আপনার এই তালিকাটি দেখতে হবে যাতে
কোন্ কাজগুলোর সময় তা থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে- তা বলা হয়েছে।
১. খাবার রান্না এবং তা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করা। ২. হাত দিয়ে খাবার খাওয়া। ৩. টয়লেট ব্যবহারের পর। ৪. আপনার আশপাশে কেউ যখন হাঁচি-কাশি দিচ্ছে বা নাক ঝাড়ছে। ৫. ময়লা কাপড়ে হাত দেয়া এবং তা ধোয়া। ৬. পোষাপ্রাণীর যতœ নেয়া। ৭. ময়লা আবর্জনা হাত দিয়ে ধরা এবং তা ফেলার জন্য নিয়ে যাওয়া। ৮. পরিবারের কারো কোন রোগসংক্রমণ হলে তার যতœ নেয়া। বিশেষ করে এর মধ্যে ১, ৩, ৪, ৬ এবং ৮ নম্বরের ক্ষেত্রে পরিষ্কার করে হাত ধোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রান্না ঘরের মধ্যে যেখানে আপনি কাঁচা মাংস কাটছেন, মোছামুছির জন্য যে কাপড় বা স্ক্রাবার ব্যবহার করছেন- তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় ঘরের মেঝে বা আসবাবপত্র ময়লা দেখায়- কিন্তু এগুলোতে যে মাইক্রোব বা অণুজীব থাকে তা তেমন কোন স্বাস্থ্য-ঝুঁকির কারণ নয়।
কী ভাবে ব্যাকটেরিয়া দূর করবেন? জিনিসপত্র কাটাকুটির বোর্ড বা থালা-বাটি ধোয়ার জন্য ব্যবহার করুন সাবান-মেশানো হাত-সওয়া গরম পানি। তবে ব্যাকটেরিয়া স্থায়ীভাবে মারতে হলে আপনাকে ব্যবহার করতে হবে ৭০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি গরম পানি, এবং তা বেশ খানিকটা সময় ধরে ব্যবহার করতে হবে। পরিষ্কার করার জন্য কি ধরণের সাবান-জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করবেন?
এগুলো হয় তিন ধরনের। একটা হলো ডিটারজেন্ট, যা সাবান-জাতীয়। এটা পরিষ্কার করে, তেলজাতীয় ময়লা দূর করে কিন্তু ব্যাকটেরিয়া নিধন করতে পারে না। আরেকটা হচ্ছে ডিসইনফেকট্যান্ট- যা ব্যাকটেরিয়া মারতে পারে কিন্তু তৈলাক্ত জায়গায় এটা ভালো কাজ করে না।
অন্যটি হলো স্যানিটাইজার- এগুলো একই সাথে পরিষ্কার করে এবং জীবাণু নাশ করে। তাই এ জাতীয় প্রোডাক্ট কেনার সময় ভালো করে জেনে নেবেন কী কিনছেন, প্যাকেটের তথ্যগুলো পড়ে নেবেন। পরিষ্কার আর স্বাস্থ্যসম্মত- দুটো যে আলাদা জিনিস তা অনেকেই বোঝেন না।
ব্রিটেনের রয়াল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথ বা আরএসপিএইচ বলছে, ময়লা, জীবাণু, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এবং স্বাস্থ্য- এই শব্দগুলোর অর্থের যে পার্থক্য আছে তা অনেক লোকই ঠিকমত বোঝেন না।
দুই হাজার লোকের ওপর চালানো এক জরিপের রিপোর্টে বলা হয়, ২৩ শতাংশ লোক মনে করেন যে বাচ্চাদের ক্ষতিকর জীবাণুর সংস্পর্শে আসা দরকার, কারণ তা হলে তাদের রোগ-প্রতিরোধী ক্ষমতা জোরালো হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একটা ক্ষতিকর ধারণা- কারণ এতে শিশুদের দেহে বিপজ্জনক সব সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে। তাদের কথা ঘর, টয়লেট, রান্নাঘর- এগুলো শুধু পরিষ্কার নয়, বরং স্বাস্থ্যসম্মত রাখাটাই সংক্রমণ ঠেকানোর কার্যকর উপায়।