‘বিপদের মাত্রা’ বুঝতে পূর্ণাঙ্গ জরিপের সুপারিশ

71

ছোট পরিসরে একটি সমীক্ষায় ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট না পাওয়ার কথা জানিয়ে এ সমস্যার মাত্রা বোঝার জন্য ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ একটি পূর্ণাঙ্গ সার্ভে করার সুপারিশ এসেছে হাই কোর্টে জমা পড়া একটি প্রতিবেদনে। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে গঠিত একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চে এই প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ‘আনফিট’ বা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ সমস্যার ব্যাপকতা ও মাত্রা বোঝার জন্য যানবাহনের, বিশেষ করে গণপরিবহনের ওপর বিজ্ঞানবিভিত্তিক একটি সার্ভে পরিচালনা করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে কোনো বিশেষায়িত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওই সমীক্ষা পরিচালনা করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির ১২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে।
বিআরটিএ-এর পক্ষে আইনজীবী রফিকুল ইসলাম প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। খবর বিডিনিউজের
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আলোচিত সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সড়ক দুর্ঘটনা। কোনো একটি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে না বরং এর সাথে বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকে। একটি মোটরযানের ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ থাকা মানেই ফিটনেস বোঝায় না। বিআরটিএ-এর নিয়ম অনুযায়ী একটি গাড়িকে প্রতি বছর একবার ফিটনেস পরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট নিতে হয়। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে সার্টিফিকেটের মেয়াদ থাকা অবস্থাতেও ওই গাড়ির যে কোনো ত্রুটি হতে পারে। অন্যদিকে বছরের পর বছর অনেক গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন না করার বিষয়টিও রয়েছে। অর্থাৎ, একদিকে ফিটনেস সার্টিফিকেট সম্বলিত গাড়ি যেমন ত্রুটিপূর্ণ হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৮ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন থাকার কথা জানিয়ে কমিটি বলেছে, এই সংখ্যা প্রতিনিয়িত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। কমিটি আদালতকে জানিয়েছে, দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে সাপ্তাহিক কর্ম দিবসে গণপরিবহন, পণ্য পরিবহন ও সিএজিচালিত অটোরিকশাসহ মোট ৮৩টি যানবাহনের ওপর জরিপ চালিয়ে এ প্রতিবেদনে তৈরি করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, ৪১ শতাংশ যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রক সিল ছিল না, ২৭ শতাংশ যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ নেই, ৩০ শতাংশ যানবাহনের সিগন্যাল লাইট নষ্ট, ২৯ শতাংশ যানবাহনের ব্রেক লাইট কাজ করে না।
তবে জরিপের ৮০ শতাংশ যানবাহনের চেসিস, ৯৬ শতাংশ যানবাহনের চাকার রাবারিং, ৯৫ শতাংশ যানবাহনের হেডলাইট, শতভাগ যানবাহনের ব্রেক, ৯৬ শতাংশ যানবাহনের স্টিয়ারিং, ৮০ শতাংশ যানবাহনের স্পিডোমিটার, ৮৩ শতাংশ যানবাহনের টেম্পারেচার গজসহ প্রায় সব ধরনের যানবাহনের দরজা-জানালা ‘ভালো’ অবস্থায় ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে বলা হয়েছে, একটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় ৫৯টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। যেহেতু এই কমিটিকে সড়কের একটি স্থান নির্ধারণ করে যাত্রীবাহী বাস বা মালবাহী ট্রাক থামিয়ে সমীক্ষা চালাতে হয়েছে, তাই সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি চেকলিস্ট তৈরি করে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে এমন ৩২টি বিষয়ে জরিপ করা হয়েছে। যানবাহনের অনেক বিষয় রয়েছে, যা পর্যবেক্ষণের জন্য পরীক্ষণ যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। কিন্তু সার্ভে টিমের কাছে এ ধরনের যন্ত্রপাতি না থাকায় চোখের দেখায় অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাছাড়া একটি গাড়ির ব্রেক সঠিক আছে কিনা তা ওই গাড়িকে কিছুটা চালিয়ে তারপর ব্রেক পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু ব্যস্ত সড়কে এ কাজটি করার সুযোগ না থাকায় তা করা সম্ভব হয়নি।
জরিপের তথ্য আগেই জানাজানি হওয়ায় এ সমীক্ষায় বাস্তব চিত্র পাওয়া নাও গিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে কমিটি।
কমিটি জানায়, সার্ভে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পুলিশের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। ধারণা করা হয় যে, সার্ভে করার বিষয়টি কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ হওয়ায় অনেক যানবাহন (সম্ভবত খারাপ যানবাহন) ওই স্থান ও সময় এড়িয়ে চলেছে। অবশ্য প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যানবাহনের ফিটনেসের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ‘ভালো’ বলেই মনে করছে সার্ভে কমিটি। তারা বলছেন, ‘যানবাহনের বিভিন্ন অংশের মান সংখ্যার দিক থেকে সর্বনিম্ন ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত সঠিক রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা শতভাগ পর্যন্ত ভালো পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ফলাফল বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না’।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস জরিপ করে দেখতে হাই কোর্ট গতবছর ৩১ জুলাই একটি জাতীয় ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করতে নির্দেশ দেয়। বিআরটিএ ১৫ সদস্যের এ কমিটি করার পর গত বছরের ২০ নভেম্বর গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় ১২টি যানবাহন, ২৭ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে বিভিন্ন শ্রেণির ১৭টি যানবাহন, ৫ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের নীমতলায় ২৩টি গাড়ি এবং ১১ ডিসেম্বর ঢাকার স্টেশন রোড ও বনানীতে ৩১টি যানবাহনসহ মোট ৮৩টি বাহনের ওপর এ জরিপ চালানো হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রওশন আরা বেগমকে আহ্বায়ক করে গঠিত ১৫ সদস্যের ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন গাজিপুরের হাইওয়ে পুলিশের সুপার মো. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের এআইজি (টিএম) এ কে এম মোশারফ হোসেন মিয়াজী, বিআরটিএ-এর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী, এলজিইডি-এর নির্বাহী পকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. মুহসীন রেজা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব আরিফ আহমেদ খান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (রোড সেফটি) মোহাম্মদ শাহীন সরকার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মো. আবুল কালাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সহ-সভাপতি মো. ছাদিকুর রহমান সরকার, ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ ভুলু, বুয়েটের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ এহসান, বুয়েটের এআরআই-এর সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ও বিআরটিএর সচিব মো. আব্দুস সাত্তার।
রিটকারীপক্ষের আইনজীবী তানভির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটি জরিপে দেখেছে, ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস নেই এবং ৫৬ শতাংশ বাসের গতি নিয়ন্ত্রক সার্টিফিকেট নেই। এর ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের কারণ ও রোধের বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত একটি পর্যবেক্ষণ করতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।