বায়োফ্লেক : যে পদ্ধতিতে দ্রুত বাড়ে মাছের উৎপাদন

22

বাংলাদেশের তরুণ মৎস্য চাষিদের মধ্যেই অনেকেই নতুন এক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন যার নাম বায়োফ্লক, যা দেশে মাছের উৎপাদন অতি দ্রুত বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মাছ চাষের এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশে এসেছে মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় বিপুল পরিমান মাছ চাষ করা হয়।
সরকারের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটা সঠিক হবে কিংবা চাষিরা কতটা লাভবান হবেন, তা নিয়ে এখন তারা গবেষণা করছেন। বায়োফ্লক পদ্ধতি দেশের এ মূহুর্তে সব চেয়ে বড় প্রকল্প করছেন ব্রাহ্মবাড়িয়ার সরাইলের জিহাদ আহমেদ। তিনি জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ চাষের চেয়ে এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সুচারুরূপে দেখতে হয়। আমি প্রায় ৩৯টি ট্যাংকে শিং, কই, মাগুর ও পাবদাসহ বেশ কয়েক ধরনের মাছ চাষ করছি।
মৎস্য গবেষকদের মতে, বায়োফ্লক এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। অর্থাৎ যে ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল তৈরি হয় তা পানিতে উৎপন্ন হওয়া নাইট্রোজেন গঠিত জৈব বর্জ্যকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হতে না দিয়ে নিজেদের বংশ বাড়ায় এবং এটিকেই ফ্লক বলে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. খলিলুর রহমান জানান, মূলত যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় অনেক পরিমান মাছ চাষ করা হয়, সেই পদ্ধতিকেই বায়োফ্লক বলা হয়। তিনি বলেন, এতে পানির মধ্যে বিশেষ কায়দায় ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা হয় এবং সেটাই মাছের খাবারকে রিসাইকেল করে – আবার এটা পানি পরিশোধন করতেও সক্ষম। তিনি বলেন, এ পদ্ধতির মাছ চাষের অবকাঠামোতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে এবং মাছের ট্যাংকের পানি পরিবর্তন করা যাবে না।
বায়োফ্লকে মাছের ট্যাংক যেমন হয় : একেবারে শুরুতে সাধারণত একটি খাচার মতো তৈরি করা হয়, যার নিচের দিকে ঢালাই দিয়ে মাটির সাথে আটকে দেয়া যেতে পারে। এর ঠিক মাঝামাছি জায়গায় পানির পাইপ সেট করা হয়। অনেকে ঢালাই না করে পলিথিন দিয়েও মেঝের জায়গা প্রস্তুত করে। পরে ওপর থেকে খাচাটি ঢেকে দিতে হবে। আর মেঝেতে পুরু পলিথিন দিয়ে পানি রাখতে হবে।
পানির তাপমাত্রা ২৪-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে, আর পানির রং হবে সবুজ, হালকা সবুজ বা বাদামী। এর দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, ক্ষারত্ব, খরতা, ক্যালসিয়াম, অ্যামোনিয়া, নাইট্রেইট, ফসফরাস, আয়রন, পানির স্বচ্ছতা, গভীরতা, লবণাক্ততা- এগুলোসহ সবকিছুর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ মেনে ব্যবস্থা নিতে হয়। এরপর পানিতে দরকারি সব উপাদান ঠিক মতো দিয়ে ফ্লক তৈরি করতে হয়, যার জন্য দরকার হয় সার্বক্ষনিক অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। ঠিক মতো ফ্লক তৈরি হলে পানির রং হবে সবুজ বা বাদামি, আর পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখা যাবে।
কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি পত্রিকায় লিখেছেন যে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনের অঙ্ক ও বাণিজ্য হচ্ছে অল্প জায়গায় অধিক মাছ। এর বাইরেও এটি মাছের খাবারের অপচয় কমিয়ে দেয়, নাইট্রোজেন গঠিত বর্জ্যকে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে রূপান্তর করে এবং পানিতে জৈব বর্জ্য জমা হওয়া প্রতিরোধ করে।
মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. রহমান জানান, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ব্যবহৃত পানিতে দুর্গন্ধ থাকে না এবং পানি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। এ পদ্ধতিতে পানির গুনগত মান বজায় থাকে, কারণ রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ হয় এক্ষেত্রে।
ঝুঁকি আছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের জিহাদ আহমেদ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে আলোচনায় এসেছেন নিজ এলাকা এবং এর বাইরেও। আর তাকে অনুসরণ করে ওই এলাকায় আরও অনেকে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
গবেষক ও মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, বায়োফ্লকের রসায়ন ঠিকমতো জানা না থাকলে এতে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এতে প্রত্যেক মাছের প্রজাতির জন্য আলাদা ধরণের পরিচর্যা বা ব্যবস্থাপনার দরকার হতে পারে।
ড. খলিলুর রহমান বলছেন, আমরা সতর্ক থেকে বায়োফ্লক নিয়ে কাজ করছি, যাতে করে উদ্যোক্তারা পরে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা বলে দিলাম আর লোকজন শুরু করে ক্ষতির শিকার হলো – এমনটি আমরা চাই না।