বইমেলায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ব্যতিক্রমী উপস্থিতি

55

জমে উঠেছে এবারের অমর একুশে বইমেলা। আগত দর্শনার্থীরা এক স্টল থেকে আরেক স্টলে যাচ্ছেন, এক বই রেখে আরেক বই পড়ছেন। কিন্তু যাদের চোখ নেই, স্বপ্নটা তাদের মনে মনে ঘুরে বেড়ায়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা চোখের কারণে বঞ্চিত হন অনেক কিছু থেকে। চলছে বইমেলার মাস। যারা সুস্থ আছেন, তারা দু’চোখ দিয়ে বিশ্বজয়ের পাশাপাশি বইমেলার পুরো সময়টা উপভোগ করছেন। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা, তাদের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে জানার-বই পড়ার অভাব ছিল। এই দূরত্বটা কমিয়ে এনেছে ব্রেইল শিক্ষা পদ্ধতি। এবার মেলায় রয়েছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। যারা অন্ধ তাদের জন্যই রাখা হয়েছে এ স্টল।
গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের অমর একুশে বইমেলার দশম দিনে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী ও হেপার স্টলে (৪৮নং) রাখা হয়েছে বিভিন্ন ব্রেইল সংস্করণের বই। প্রকাশিত হয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাহি জি চৌধুরীর কবিতার বই ‘মুক্ত কবির কাব্য’। কৌতূহলী দর্শকরা ভিড় করেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের এ স্টলে।
সন্ধ্যার আগে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনীর স্টলে এক অন্ধ যুবক হাত দিয়ে স্পর্শ করে কি যেন পড়ছেন। কাছে গিয়ে দেখি বড় একটি বইয়ের উপর বিন্দু বিন্দু করে আঁকা, যেটিই ব্রেইল ভাষা নামে পরিচিত। যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তারাই শুধু এ বইয়ের মাধ্যমে পড়তে পারেন। বই পড়ুয়ার নাম মো. আল আমিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে স্নাতক নিয়ে পড়ছেন। মাঝে মাঝে হাতের স্পর্শ ঠিকভাবে না হওয়ায় থেমে যাচ্ছিলেন। তারপরেও পড়ে যাচ্ছেন। আইনের ছাত্র হলেও পড়ছিলেন মুনতাসির মামুনের লেখা ঢাকার কথা বইয়ের ব্রেইলি সংস্করণ।
তাছাড়াও মেলার স্টলে দাঁড়িয়ে হাতের স্পর্শে বই পড়ছিলেন রাহি জি চৌধুরী, আবিদুর রহমান, মোর্শেদা আক্তার মৌসুমীসহ আরও অনেকে। সকলেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও হাতের স্পর্শ এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে তারা সবাই আলোকিত।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেলায় আগত সকলেই নগরীর মুরাদপুর সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল থেকে পাস করে বর্তমানে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তারা শুধু বইপড়া নয়, স্মার্ট ফোন চালানো এবং কম্পিউটার চালানোতেও সমানভাবে পারদর্শী। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে স্মার্ট ফোন এবং রয়েছে নিজস্ব ফেসবুক একাউন্ট। সভ্যতার প্রতিটি প্রযুক্তির সাথে তারা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছেন এবং মানিয়ে চলছেন। পিছিয়ে নেই সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাহি জি চৌধুরী রাহী বর্তমানে সরকারি সিটি কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, বইয়ের পর্যাপ্ত ব্রেইলি সংস্করণ না থাকায় পড়ার ইচ্ছা থাকলেও আমরা অনেক বই পড়তে পারি না। কোন লেখক আমাদের কথা চিন্তা করে না। আমরা তো সমাজেরই অংশ। ব্রেইলি সংস্করণে পড়ালেখা করলেও লিখতে পারছি না। আমি মনে করি প্রতিটি লেখকের উচিত আমাদের কথা চিন্তা করে তাদের বইগুলোর ব্রেইলি সংস্করণে বের করা।
সরকারি সিটি কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র মো. আবিদুর রহমান বলেন, আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও আবেগ-ভালোবাসার অনুভূতি আছে। আমরাও সমাজের আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হয়ে বাঁচতে চাই। আমরা সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা নই। আমরা যখন পরীক্ষা দেওয়ার সময় শ্রুতিলেখক পাই না, পেলেও দুয়েকটা পরীক্ষার পর চলে যায়। ফলে পরীক্ষার সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক সংগঠন হেলথ, এডুকেশন এন্ড পোভার্টি এলিভিয়েশন (হেপা)। প্রতিবছর ঢাকায় অমর একুশে বইমেলায় স্পর্শ ব্রেইলি প্রকাশনীর স্টল থাকলেও চট্টগ্রামে এ প্রথমবারের মতো স্টল বরাদ্দ নিয়েছে তারা।
হেপা’র নির্বাহী পরিচালক নাসিমা শওকত বলেন, প্রতিবন্ধী মানে প্রতিভাবন্দী নয়। তাদের প্রতিভার কথা প্রায় সবার কাছে অজানা। তাদের প্রতিভা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে আমাদের এ আয়োজন। এরা এখন আর পিছিয়ে নেই। অন্য দশজন মানুষের মতো প্রযুক্তির সবক্ষেত্রে সমানভাবে পারদর্শী তারা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের তো বেশি অর্থ নেই। তাই আমরা বাছাই করে মাত্র ৮০টি বইয়ের ব্রেইলি সংস্করণ বের করেছি। আমাদের লেখকরা হয়তো জানেন না তাদের পাঠকদের একটা অংশ প্রতিবন্ধী। তারাও বাকি সবার মতো পড়তে চায়। এছাড়া আরও অনেক সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত আছে সামাজিক সংগঠন ‘হেপা’। নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন রোগের সকল পরীক্ষা ও টিকা দেওয়া হয় এই স্টলে। আজ ‘হেপা’র স্টলে হেপাটাইটিস-‘এ’ এবং ‘বি’, জন্ডিস ও জরায়ু ক্যান্সারের টিকা প্রদান কর্মসূচি। কেউ চাইলে আমাদের স্টল থেকে করিয়ে নিতে পারবেন।