ফিটনেসবিহীন ২৫ হাজার গাড়ি সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে

111

‘চট্টমেট্রো-জ-১১-০৮৬৪’ নম্বরের মিনিবাসটি চলাচল করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে। ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে নবায়ন করা হয়নি মহাসড়কের চট্টগ্রাম-আমিরাবাদ রুটে চলাচলকারী এ বাসটির ফিটনেস। অথচ আমিরাবাদ থেকে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত আসতে পেরুতে হয় ৬টি থানা, একটি হাইওয়ে পুলিশের থানা, একটি হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়ি, জেলা ট্রাফিক পুলিশের ফাঁড়ি ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চারটি চেকপোস্ট।
‘চট্টমেট্রো-ব-১১-০১১৩’ নম্বরের বাসটি চলাচল করে মহাসড়কের চট্টগ্রাম-চকরিয়া রুটে। ২০১৮ সালের ৭ মার্চ মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করা হয়নি ফিটনেস সনদ। আবার ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ দিয়েই চট্টগ্রাম-পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) চলাচল করছে ‘চট্টমেট্রো-জ-০৫-০১২৩’ নম্বরের মিনিবাসটি।
একইভাবে ‘চট্টমেট্রো-ব-০৫-০০৭৫’ নম্বরের বাসটির ফিটনেস মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি, ‘চট্টমেট্রো-ব-০২-০১৬৭’ বাসটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের ১৭ জুন, ‘চট্টমেট্রো-জ-১১-০২৭১’ মিনিবাসটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর, ‘চট্টমেট্রো-জ-১১-০২৪৩’ মিনিবাসটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রূয়ারি এবং ‘চট্টমেট্রো-জ-১১-১৩৮৯’ মিনিবাসটির ফিটনেসের মেয়াদ ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল শেষ হলেও আজ পর্যন্ত নবায়ন করা হয়নি।
পূর্বদেশ’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ফিটনেসবিহীন গাড়ির এ চিত্র।
শুধু এসব বাস-মিনিবাস নয়, বিভিন্ন ধরণের ফিটনেসবিহীন প্রায় ২৫ হাজার যানবাহনের রাজত্ব চলছে চট্টগ্রামের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম থেকে নিবন্ধন নিয়ে চলাচলকারী প্রায় ২ লাখ যানবাহনের মধ্যে এসব গাড়ি ফিটনেস ছাড়াই সড়কে চলাচল করছে। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। অকালে ঝরছে বহু প্রাণ। দীর্ঘ হচ্ছে প্রাণহানির তালিকা। অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ঢাকার প্রগতি স্মরণিতে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর বাসচাপায় প্রাণ হারান শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। এরপর থেকেই সড়কে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি ফের আলোচনার আসে।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি থেকে সর্বশেষ গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৪ হাজার ৫৩৬টি যানবাহন ফিটনেসবিহীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে আছে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার, ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনার মুভার, মাইক্রোবাস, জিপ, প্রাইভেট কার, অটোটেম্পো ও অটোরিকশা। মোটরযান আইনে মোটরসাইকেল ছাড়া সব যানবাহনের প্রতিবছর ফিটনেস সনদ নিতে হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী মিনিবাস, হিউম্যান হলারগুলোর জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা। সামনে পেছনে দুমড়ে মুচড়ে লক্কর-ঝক্কড় হয়ে পড়েছে অসংখ্য মিনিবাস। কোনোটির সামনের কাচ নেই, বাতি নেই, বাসের বডি ভাঙাচোরা। গাড়ির সামনে পেছনে নেই সিগন্যাল লাইটও। তাছাড়া অসংখ্য গাড়ির চালকের নেই বৈধ লাইসেন্স। অপ্রাপ্ত বয়স্করা চালাচ্ছে এসব মিনিবাস ও হিউম্যান হলার। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে।
মোটরযান আইন অনুযায়ী- যানবাহনের ফিটনেস সনদ পাওয়ার মূল শর্ত হচ্ছে কারিগরি ও বাহ্যিকভাবে চলাচলের উপযোগী হওয়া। এক্ষেত্রে যানবাহনের ৬০টির মতো কারিগরি ও বাহ্যিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যানের ইঞ্জিনের পুরো কার্যকারিতা, আকৃতি ও নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা, ওজন ঠিক আছে কি না, কালো ধোঁয়া বের হয় কিনা এবং ব্রেক, লাইট ও বাহ্যিক অবয়ব ঠিক আছে কিনা। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার নিয়ম। অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে বিআরটিএ কর্মকর্তারাই যানবাহনের ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলার পেছনে ট্রাফিকের অসাধু কর্মকর্তারাই দায়ী। মাসোহারার বিনিময়ে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে থাকে।
বুধবার কথা হলে বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেল-২ এর সহকারী পরিচালক উসমান সরোয়ার আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ২৪ হাজার ৫৩৬টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে চালকরা আগের স্টপিজে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ইউটার্ন দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দেন। তখন যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন। তাই যাত্রীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে এক জায়গায় বেশি সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তাই ভিন্ন ভিন্ন মোড়ে অল্প সময় নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিআরটিএ কর্মকর্তারা চাইলেই আইন প্রয়োগ করতে পারেন না। কিন্তু পুলিশ বিশেষ করে সড়কে ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন। চলাচল উপযোগী যেসব গাড়ি রয়েছে সেগুলোর মালিকরা বাধ্য হয়েই গাড়ির ফিটনেস নেবেন। এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।’
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের টিআই (প্রশাসন) মীর নজরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘সড়ক-মহাসড়কে আমরা যখনই ফিটনেসবিহীন গাড়ি পাই, ধরে মামলা দিই। ‘ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহনই সড়কে চলতে দেওয়া হবে না’- জেলা ট্রাফিকের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া আছে।’