পড়ুয়া

90

আজ ছুটি।
ভাইবোনের লুটোপুটি। খুনসুটি। অনাবিল আনন্দ। আকাশে মেঘ জমেছে। ভীষণ কালো। হুতুম পেঁচার রাগ দেখেছো? হুপ্পপপ। গোমড়া মুখো। অপরাজিতাও মুখ গোমড়া করে রেখেছে। হুতুম পেঁচার মতো। একটু আগে আবরার বোনকে বলেছে, কোনো লেখাপড়া নেই। আব্বুকে আদর দিয়ে বসে বসে কার্টুন দেখা হচ্ছে।
মোটেও কিন্তু তা নয়। আব্বু মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। বাজারে যাবে। পানি খেতে চাইলো আব্বু। অপরাজিতা পানি খেতে দিলো। আব্বু পানি খেয়ে বললো, ল²ী মা আমার। আয় আমার পাশে বোস। আমার তো মা নেই, তুই আমার মা। তুইই আমার সব দেখভাল করিস। খবর রাখিস। এমনিতেও মেয়েরা বাপ-ন্যাওটা হয়। এই যা।
আবরারটা অপরাজিতাকে শুধু শুধু রাগায়। অমনি অমনি খোঁচা দেয়। অতিমাত্রায় রেগে গেলে অপরাজিতাও মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। ঠিক মেঘের মতো। এই বুঝি মুষলধারে নামলো বৃষ্টি। অপরাজিতার ভালোই লাগে। রান্নাঘরে কী হচ্ছে কে জানে? সারাক্ষণ খট্খট্—খুট্খুট্ শব্দ। মৌ মৌ গন্ধ নাকে আসছে। ছুটির দিন। মনে হচ্ছে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। মায়ের হাতের রান্না বলে কথা। তুলনা হয়না।
খোলা ব্যলখনিতে বেতের ইজিচেয়ারটা। হালকা বাতাসে একা একা দুলছে। তাই দেখে মাথা নাড়ছে টবের ছোট গাছগুলো। হায়-হ্যালো করছে পাতাগুলো। বলছে,্এসো মিতালি পাতি। কখনো কখনো দুই-একটা প্রজাপতি এসে বসে। টবের গাছগুলোতে। মাঝে মধ্যে দু-একটা চড়–ই পাখিও আসে। অপরাজিতা দরজা ফাঁক করে চুপি চুপি চেয়ে থাকে। ইচ্ছে হয় দু’হাতে ঝাপটে ধরতে। পারে না। ফুড়–ৎ করে পালিয়ে যায়। একটু দূরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঠিক উড়ে গিয়ে ওখানটায় গিয়ে বসে। অপরাজিতার চেয়ে চেয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
আজ ছুটির দিন। আব্বু ভোরে উঠে বাজার করে এনেছেন। বন্ধের দিন। বাসায় একটু ভালোমন্দ রান্না হয়। এখন ড্রইং রুমে। সোফায় হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। মনোযোগ দিয়ে। কী যেন খুঁজছেন। একটা জায়গায় চোখ আঁটকে গেলো। নিখোঁজ সংবাদ। আট-দশ বছরের একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। মেয়েটির নাম ইফতি। গায়ে লাল রঙের ফ্রক। মেয়েটির একটি ছবি দেওয়া আছে। ঠিক অপরাজিতার বয়েসী। অপরাজিতার মতোই চেহারা। অপরাজিতা কাছে আসতেই আব্বু আলতো আদরে বুকে জড়িয়ে নিলেন মেয়েকে। অপরাজিতা কিছুই বুঝলো না। জিজ্ঞাসা করলো,
আব্বু কী হয়েছে। তোমার শরীর খারাপ?
না রে মা।
তোমাকে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে।
ঠিক বলেছিস।
কেন আব্বু?
তোর মতো একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে।
কোথায়?
ঐ তো পত্রিকার পাতায়। নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে ছবি ছাপা হয়েছে।
কোনো ছেলেধরা নিয়ে যায়নি তো আব্বু?
কী করে বলবো মা। আজকাল কত ধরণের বিপদ। প্রতি পদে পদে ওৎ পেতে আছে।
তাহলে মেয়েটা খাবে কী? থাকবে কোথায়? ওর বুঝি কষ্ট হবে না? ওর মা-বাবার বুঝি কষ্ট হবে না?
অপরাজিতার মনে আরও অনেকগুলো প্রশ্ন। এতগুলো প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গিয়ে আমজাদ হোসেনের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখে পানি এলো। আজকাল পত্রিকার পাতায় শিশু নির্যাতনের কী বীভৎস সংবাদগুলো প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে। গা শিউড়ে ওঠে। নিজের মেয়ের ছবিটা ইফতির জায়গায় চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
আমজাদ হোসেন অস্থির হয়ে ওঠেন। এসমস্ত সংবাদগুলো প্রতিনিয়ত ভাবায়। কোনো কিনারা করতে পারে না। নিজের দুটো ছেলে মেয়ে। ভাবে, ছেলেমেয়ে দুটোকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারবো তো? নিরাপদে বড় করে তুলতে পারবো তো? স্কুলেও দুষ্ট-রাজনীতির কালো ছায়া পড়ছে। স্কুলের কোমলমতি ছেলেগুলো রাজনীতির নামে বড় ভাইয়াদের ছত্রছায়ায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধে। পাড়ায় মহল্লায় তৈরী হচ্ছে কিশোর গ্যাং। কী হবে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত?
আর কিছু ভাবতে পারছেন না আমজাদ হোসেন। অপরাজিতাকে বুকে টেনে নিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। অপরাজিতা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তারপর উঠে গিয়ে আবরারের পড়ার ঘরে যান। আবরার তখনও একমনে বাবার মোবাইলে গেইম খেলছে। বাবার উপস্থিতি একদম খেয়াল করতে পারেনি। মোবাইলে নিবিড় মনোযোগ। আমজাদ হোসেন পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছেন। অপরাজিতা বুক শেল্প থেকে একটা বই নিয়ে বাবার পেছনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে, দেখেছো বাবা, লেখাপড়ার নাম নেই, সারাক্ষণ শুধু মোবাইল আর গেইম।
অপরাজিতা জানে, এখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। আবরারের চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছে। এই সময়তো পড়ার কথা। আবরার বুঝতে পারছে। ভাগ্যিস বাবা বাজারে যাওয়ার সময় মোবাইলটা রেখে গিয়েছিলো। তাই একটু খেলতে বসেছে। খেলতে গিয়ে এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছে, বাবার পায়ের শব্দটাও কানে যায়নি।
আমজাদ হোসেন কিছুই বলেনি। বুঝতে পারছে ছেলেটা ভয় পেয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, পড়তে বসো বাবা। বারান্দায় এসে দেখলো, অপরাজিতা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শব্দ করে পড়ছে, “আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে…”।