‘নেগেটিভ’ জানার আগে চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি

24

 

নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে চট্টগ্রামেও জ্বর কিংবা শ্বাসকষ্টের রোগী নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের স্বজনদের; ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতালে হাসপাতালে। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় এরকম কমপক্ষে ছয়টি ঘটনায় রোগীর স্বজনদের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চারজন রোগীর মৃত্যুও ঘটেছে, যার জন্য চিকিৎসকদের দ্বিধাগ্রস্ততাকে দায়ী করা হচ্ছে। খবর বিডিনিউজের
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম ‘কিছু সমস্যা’ হয়েছে। তবে সেটি করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ও চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) না থাকার কারণে। এখন পর্যাপ্ত কিট ও পিপিই থাকায় সব হাসাপাতালের ফ্লু কর্নারগুলো সচল হচ্ছে। এবং উপজেলা পর্যায়ে সোয়াব সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এ সমস্যা আর থাকবে না।
পাশাপাশি যে রোগী যে হাসপাতালে আছেন করোনভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফল না আসা পর্যন্ত সেখানে রেখেই ওই রোগীকে চিকিৎসা দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দা সানজিদা ইসলাম সুমাইয়া (১৬) জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন ২৬ মার্চ থেকে। এরপর ছয় দিনে পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরেও কাঙ্খিত চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ সুমাইয়ার বাবা রফিকুল ইসলামের। সবশেষে বুধবার করোনাভাইরাস পরীক্ষার ‘নেগেটিভ’ ফল আসার পর চিকিৎসা পান সুমাইয়া।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুরুতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখে ওষুধ দেন। ২৬ তারিখ রাতে অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় উপজেলার কয়েকটা ক্লিনিকে যাই, সব বন্ধ। শহরে একটা ক্লিনিকে এক্সরে করার পর বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে। সেখান থেকে পাঠায় জেনারেল হাসপাতালে। তখন গভীর রাত। তারা বলে বিআইটিআইডিতে পরীক্ষা করাতে। অত রাতে কোথায় যাব? পরদিন সকালে ফৌজদারহাটে (বিআইটিআইডিতে) নিয়ে যাই। অনেক অনুরোধ করে সেখানে পরীক্ষা করাই। সেখান থেকে ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেয়। এরপর কয়েকটা ক্লিনিকে ঘুরেও ভর্তি করাতে না পেরে বাড়ি চলে যাই। পরশু রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পর চমেকে আমার মেয়ের চিকিৎসা শুরু করে। এখন আপনাদের দোয়ায় সে ভালো আছে, বাড়িতেই আছে। তার জ্বর নেই।’
নগরীর আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতালে আইসোলেশন এবং সীতাকুন্ড উপজেলার ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে করোনভাইরাস পরীক্ষা ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা আছে।
কক্সবাজারের বৌদ্ধঘোনা এলাকার কিশোর ওমর সিদ্দিকের (১৫) জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় তার বাবা আবদুল হামিদ তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন ৩১ মার্চ।
সেখানকার জরুরি বিভাগ থেকে সাময়িক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে তাকে নেওয়া হয় জেনারেল হাসপাতালে। ১ এপ্রিল সকালে মারা যান ওমর। সেদিন রাতে বিআইটিআইডির পরীক্ষার ফলে জানা যায়, তার করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রামের একজন চিকিৎসক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওমর সিদ্দিক আসলে সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি।
চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দা বাবুল বড়ুয়ার (৬২) ২৫ মার্চ হার্ট অ্যাটাক হলে তাকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়। শ্বাসকষ্ট থাকায় সেখানে থেকে তাকে পাঠানো হয় জেনারেল হাসপাতালে।
এরপর বিআইটিআইডি ও একটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে ২৭ মার্চ রাতে তাকে ভর্তি করানো হয় নগরীর রয়েল হাসপাতালে। ২৮ মার্চ সকালে মারা যান তিনি। এরপর আসা প্রতিবেদনে জানা যায় তারও করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’, তার শ্বাসকষ্টের কারণ হৃদরোগ।
বেসরকারি রয়েল হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, বাবুল বড়–য়াকে শেষ সময়ে আনা হয়েছিল।
সাতদিন ধরে জ্বর-সর্দি নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডাক্তারের চেম্বার ঘোরার পর বৃহস্পতিবার নগরীর হালিশহরের বাসিন্দা এক তরুণ (১৭) কোতোয়ালী থানায় হাজির হয়ে কান্না শুরু করেন। পরে নগর বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার আব্দুল ওয়ারিশের উদ্যোগে পুলিশের গাড়িতে করে সেই তরুণকে আইসোলেশনের জন্য নির্ধারিত জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে দুই দিনের ওষুধ দিয়ে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন।
মঙ্গলবার রাতে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভোগা দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক নারী বিআইটিআইডিতে মারা যান। তাকে চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ থেকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। বুধবার নমুনা পরীক্ষায় ফল পেলে জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না।
সীতাকুন্ড পৌর সদরের পন্থিছিলা এলাকার রফিক আহমদের স্ত্রী মমতাজ জাহান (৫৫) জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে উপজেলার কোনো ক্লিনিকে চিকিৎসক না পেয়ে ২৮ মার্চ নগরীর বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি হন।
মমতাজ জাহানের ছেলে মো. নাঈম আহমদ বলেন, মা’র ডায়বেটিস ও প্রেসার ছিল। জ্বর বাড়লে ৩০ মার্চ মাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।
৩১ মার্চ হাসপাতালের লোকজন বলেন, আপনার মার করোনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তাকে নিয়ে যান। আমরা রাজি না হওয়ায়, বিআইটিআইডিতে খবর দেওয়া হয়। তারা এসে স্যাম্পল নিয়ে যায়।
নাঈম আহমেদের বলেন, এরপর হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবু নাসের বলেন, আইসিইউতে আপনার মাকে রাখলে ডাক্তাররা কাজ করবেন না। রিপোর্ট আসা পর্যন্ত রাখতে বললেও তারা রাজি হয়নি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আইসিইউ থেকে বের করে মাকে কেবিনে দেয়া হয়, সাড়ে ৭টায় তিনি মারা যান।
মমতাজ জাহানের মৃত্যুর পর ওই হাসপাতালের লোকজন তাদের কেবিন থেকে বের হতে নিষেধ করেন এবং মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেও সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ নাঈমের।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক আবু নাসের সাংবাদিকদের বলেন, রোগীর স্বজনদের সাথে আলোচনা করেই তাকে কেবিনে দেয়া হয়েছিল। উনার শারীরিক অবস্থা আগে থেকেই খুব খারাপ ছিল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, মমতাজ জাহানের নমুনা পরীক্ষার বিষয়টি জানি। কী অবস্থায় তিনি মারা গেছেন, সেটা জানি না। এ বিষয়ে তার পরিবার কোনো অভিযোগ দেয়নি। তবে কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। আজও একটি বেসরকারি হাসপাতালে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে। বলেছি, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত রোগীকে রাখতে হবে, চিকিৎসা দিতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা অলরেডি কাজ করছি।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ গঠিত কোভিড-১৯ বিষয়ে বিভাগীয় কমিটির সমন্বয়ক ডা. মিনহাজুর রহমান বলেন, শুরুতে জ্বর-কাশির সাথে অন্য গুরুতর অসুস্থতা আছে এমন মুমূর্ষু রোগীদেরও জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছিল। এতে কিছুটা সমস্যা হয়। এখন পর্যাপ্ত কিট এবং পিপিই আছে। যে রোগী যেখানেই আছে বিআইটিআইডিতে জানালে তারা নমুনা সংগ্রহ করবে। পরীক্ষার ফল আসার পর সিদ্ধান্ত হবে।
ডা. মিনহাজুর রহমান বলেন, প্রথমদিকে সরকারি-বেসরকারি হাসাপাতালগুলো ফ্লু কর্নারগুলোতে পিপিই সঙ্কট ছিল। এখন তা নেই। ফ্লু কর্নারে রোগী দেখার পর লক্ষণ থাকলে জেনারেল হাসপাতালে পাঠাবে। সেখানে সেবা দেয়া হবে।
উপজেলাগুলোতেও সোয়াব সংগ্রহের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আশাকরি আর এধরনের কিছু হবে না। করোনা রোগীও যদি হয় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাই সেবা পাবেন।