দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালসহ ২০ আদালত বিচারকশূন্য

48

চট্টগ্রাম আদালতে বিচারক সংকট সেই তিমিরেই রয়েছে। বছরের গোড়ার দিকে জেলা আইনজীবী সমিতি বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ সংকট উত্তরণে সম্ভব সবকিছু করার অঙ্গীকার করলেও পরিস্থিতির দৃশ্যত কোনও পরিবর্তন হয়নি। ফলে প্রায় ছ’মাস আগের মতই ৯০টি আদালতের মধ্যে বর্তমানেও অন্তত ২০টি আদালতে বিচারকশূন্যতা বিরাজ করছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান আদালতে বিরাজমান বিচারক সংকট পরিস্থিতির পরিবর্তনে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে পূর্বদেশকে বলেন, দ্রæতবিচার ট্রাইব্যুনালসহ ২০টি আদালতে দীর্ঘদিন বিচারক না থাকায় বিচারপ্রার্থীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মামলা-ব্যয় বাড়ছে। নির্ধারিত শুনানির দিনে দূর-দূরান্ত থেকে বিচারপ্রার্থীরা আদালতে হাজির হলেও বিচারকশূন্যতার কারণে তাদের মামলার কার্যক্রম থেমে রয়েছে। বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হওয়ায় অনিষ্পন্ন মামলার পাহাড় জমছে। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠক রানা দাশগুপ্ত বিচারকশূন্যতা কিংবা অন্য যে কোনও কারণেই মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতাকে বিচারহীনতারই নামান্তর উল্লেখ করে পূর্বদেশকে বলেন, ‘মামলার বিচার নির্ধারিত সময়ে শেষ করা না গেলে মামলার ব্যয় বেড়ে যায়। অনাকাক্সিক্ষত দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থী লোকজন প্রতিকারের জন্য আদালতে আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এর চেয়ে মানুষ বিচারবহির্ভূত পন্থায় দ্রæততম সময়ে সুবিধাজনক সমাধানকেই আশ্রয় হিসেবে বেছে নিতে পারেন। ফলে, আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থার সঙ্কট তৈরি হবে। এর প্রভাবে সমাজে অসহিষ্ণুতা ও সংঘাতের প্রসার ঘটতে পারে। সেজন্য কোন মামলার ন্যায্য সময়েই বিচার নিষ্পত্তি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে, বিচারকশূন্যতা বা অন্য যে কোন প্রতিবন্ধকতা সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবমিলিয়ে ৯০টি আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে ঝুলছে দুই লাখের বেশি মামলা। এর মধ্যে ২০টি আদালতে দীর্ঘদিন ধরে বিচারকশূন্যতা বিরাজ করছে। এসব আদালতে অন্তত ৩০ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারক না থাকায় থমকে আছে মামলার বিচারকাজ। বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে চট্টগ্রাম বিভাগের দুর্নীতি ও চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমানে আদালতটিতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে সাতশ’রও বেশি। বিশেষ এই আদালতের বিচারক রুহুল আমিন গত ৭ জানুয়ারি বদলি হওয়ার পর থেকে এ আদালতে বিচারকশূন্যতা বিরাজ করছে। একইভাবে বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেও চলছে বিচারক সংকট। গুরুত্বপূর্ণ এ আদালতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য আদালত থেকে চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির জন্য এ ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হয়। শতাধিক মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় এই ট্রাইব্যুনালও বিচারকশূন্যতার কবলে পড়েছে। বিগত ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুালের বিচারক মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুালের বিচারক হিসেবে বদলি করার পর থেকে এই ট্রাইব্যুনালে বিচারক সংকট শুরু হয়। দীর্ঘদিন বিচারকশূন্য থাকার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হোসনে আরা বেগমকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজে দায়িত্ব নেয়ার আগেই অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান তিনি। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর বিচারক মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে ওই ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মাত্র দুই মাস কাজ করার পর গত বছরের নভেম্বরে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এরপর থেকে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল বিচারকশূন্য রয়েছে।
বিভাগীয় এই দুই গুরুত্বপূর্ণ আদালত ছাড়াও বিচারক সংকট রয়েছে আরও ১৮টি আদালতে। এর মধ্যে জেলা জজশিপের অধীনে দেউলিয়া আদালত, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ এবং সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, স›দ্বীপের সিনিয়র সহকারী জজ, পটিয়া চৌকির আওতাধীন চন্দনাইশ আদালতের সহকারী জজ, পটিয়া চৌকির অতিরিক্ত আদালতের সহকারী জজ, সাতকানিয়া চৌকির অতিরিক্ত আদালতের সহকারী জজ, সাতকানিয়া চৌকির লোহাগড়া আদালতের সহকারী জজ, বাঁশখালী চৌকির সহকারী জজ আদালতগুলোতেও বিচারকশূন্যতা বিরাজ করছে। এছাড়াও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে দ্বিতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারক সংকট বিরাজ করছে।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, বিচারকশূন্যতার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে বিচারপ্রার্থীরা। একেকটি মামলার জন্য কেউ কেউ মানুষ ১০ বছর কিংবা ২০ বছর ধরে আদালতে আসা-যাওয়া করছে। অথচ মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।