চন্দ্রবিজয় সাজানো নাটক নাকি সত্য ঘটনা

77

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা কর্তৃক চাঁদে মানুষের পদার্পণের ৫০ বছর পূর্তি হতে চলেছে এ বছর। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই অ্যাপোলো ১১ মিশনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মানুষ চাঁদে অবতরণ করে। ঐতিহাসিক সেই অভিযানে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম চাঁদে গিয়ে যখন নেমেছিলেন মার্কিন নভোচারীরা, সেই ঘটনা বিশ্বজুড়ে টিভিতে দেখেছেন কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু পৃথিবীতে এখনো এমন বহু মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করেন, মানুষ আসলে কোনদিন চাঁদে যায়নি। বাস্তবে কি মানুষ চাঁদে যায়নি?
এমনকী মার্কিন নাগরিকরাও অনেকে বিশ্বাস করে না মানুষ চাঁদে গিয়েছে। নাসা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ চালিয়েছে। তাদের জরিপে সব সময় দেখা গেছে, চাঁদে মানুষ যাওয়ার ব্যাপারটিকে সাজানো ঘটনা বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষ। এদের সংখ্যা কম, কিন্তু চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে অবিশ্বাস ছড়ানোর জন্য যড়যন্ত্র তত্ত¡ জিইয়ে রাখতে সেটিই যথেষ্ট।
চাঁদে যাওয়া কী ধাপ্পা?
অনেকেই চাঁদে মানুষ যাওয়ার ব্যপারটিকে পুরোপুরি ধাপ্পাবাজি মনে করেন। শুধু তাই নয়, তারা এর স্বপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। এরা মনে করেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র সেরকম প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তখনো ছিল না, যেটি এ অভিযানের জন্য দরকার ছিল।
তারা বলেন, নাসা তাদের অভিযান যে সফল হবে না, সেটা বুঝে ফেলেছিল। কাজেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাকাশ অভিযানে টেক্কা দেয়ার জন্য হয়তো চাঁদে সফল অভিযান চালানোর নাটক সাজিয়েছে। কারণ সে সময় মহাকাশ অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে ছিল, এমনকি তারা চাঁদের বুকে একটি যান ক্র্যাশ ল্যান্ড করিয়েছিল।
এই তত্ত্ব নতুন নয়, নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ষড়যন্ত্র তত্ত¡ ডালপালা ছড়াতে থাকে। তবে এসব গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পাত্তা পেতে শুরু করে ১৯৭৬ সালে একটি বই প্রকাশ হওয়ার পর। বইটির লেখক একজন সাংবাদিক বিল কেসিং। নাসার একটি ঠিকাদার কোম্পানির জনসংযোগ বিভাগে তিনি কিছুদিন কাজ করেছিলেন। তার বইটির নাম ছিল, ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকাস থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল।
বইটিতে বিল কেসিং লিখেছেন, মানুষ কখনো চাঁদে যায়নি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসলে তিন হাজার কোটি ডলারের প্রবঞ্চনা করা হয়েছে। এই বইতে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল যা পরবর্তী বছরগুলোতে চন্দ্র অভিযানের সাফল্যে অবিশ্বাসীরা এই বিতর্কে সবসময় উল্লেখ করেছেন।
চন্দ্র অভিযান বিষয়ে অবিশ্বাসীরা কিছু ছবি দিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁদের প্রশ্ন, চাঁদে তো বাতাস নেই, তাহলে সেখানে মার্কিন পতাকা উড়লো কীভাবে। তাঁদের আরও প্রশ্ন থাকে, নাসার ছবিতে চাঁদের আকাশে কেন তারা দেখা যায় না?
তবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে নাকচ করে দেয়ার মতো অনেক বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে বলে জানিয়েছেন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মাইকেল রিক। তিনি বলেন, নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন যখন পতাকাটি খুঁটি দিয়ে চাঁদের মাটিতে লাগাচ্ছিলেন, তখন সেটি কুঁচকে গিয়েছিল। আর যেহেতু পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছয় গুণ কম, তাই কুঁচকানো পতাকাটি সেরকমই থেকে গিয়েছিল।
চাঁদের আকাশে কেন তারা নেই ?
চাঁদে যাওয়ার বিষয়টি যারা বিশ্বাস করেন না, তারা প্রায়ই প্রমাণ হিসেবে এই বিষয়টির কথা উল্লেখ করেন। তাদের প্রশ্ন, কেন চাঁদে নামার এই ছবির পেছনের আকাশে কোনো নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না?
এটা কেন? এ প্রশ্নের জবাবে রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সের অধ্যাপক ব্রায়ান কোবারলিন বলেন, এর কারণ, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। সে কারণে ছবিতে এত উজ্জ্বলতা চোখে পড়ছে। আর এই উজ্জল আলোর কারণেই পেছনের আকাশের তারকার আলো ম্লান হয়ে গেছে। এ কারণেই অ্যাপোলো ১১ মিশনের ছবিতে চাঁদের আকাশে কোন তারা দেখা যায় না। কারণ এসব তারার আলো খুবই দুর্বল। আর ক্যামেরার এক্সপোজার টাইমও হয়তো ছিল অনেক বেশি।
চাঁদে মানুষের পায়ের ছাপ কি নকল ?
চন্দ্রাভিযানে নভোচারীরা চাঁদের বুকে যে পায়ের ছাপ রেখে এসেছিলেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাঁদের কথা হচ্ছে, চাঁদে কোনো আর্দ্রতা নেই। কাজেই বাজ অলড্রিনরা সেখানে যে পায়ের ছাপ রেখে এসেছেন, সেগুলো হওয়ারই কথা নয়।
প্রশ্নটির উত্তরে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক রবিনসন। তিনি বলেন, ‘চাঁদের মাটি এক ধরনের পাথর আর ধুলায় ঢাকা, যার নাম রেগোলিথ। এই স্তরটি খুবই ফাঁপা, এবং পা রাখলেই তা ডেবে যায়। আর মাটির কণাগুলো যেহেতু একটার সঙ্গে একটা লেগে থাকে, তাই জুতোর ছাপ পড়ার পর সেটি সেভাবেই থেকে যায়।
রবিনসন আরো বলেন, চাঁদের বুকে নভোচারীদের এই পায়ের ছাপ থেকে যাবে লক্ষ লক্ষ বছর, কারণ সেখানে যেহেতু কোন বায়ুমন্ডল নেই, তাই কোনো বাতাসও নেই।
তেজস্ক্রিয়তায় নভোচারীরা মারা যাননি কেন?
চন্দ্রাভিযান নিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে, পৃথিবীকে ঘিরে যে তেজস্ক্রিয়তার পরিমন্ডল, সেটিতে নভোচারীদের মারা যাওয়ার কথা। এ তেজস্ক্রিয়তা ভেদ করে কীভাবে চাঁদে যেতে পারে নভোচারীরা?
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীকে ঘিরে এই তেজস্ক্রিয় অঞ্চলটিকে বলে ‘ভ্যান অ্যালেন বেল্ট এবং সৌর ঝড় আর পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্রের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এই তেজস্ক্রিয়তার সৃষ্টি হয়। মহাকাশ অভিযান নিয়ে যখন প্রতিযোগিতা শুরু হলো, তখন এই বিকীরণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও উদ্বেগ ছিল। তাদের আশংকা ছিল মানুষ মারাত্মক মাত্রার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হতে পারে।
নাসার বিজ্ঞানীদের দাবি, অ্যাপোলো-১১ এর ক্রুরা চাঁদে যাওয়ার সময় ভ্যান অ্যালেন বেল্টে ছিলেন মাত্র দুই ঘন্টা। আর এই বেল্টের যে অঞ্চলটিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা সবচেয়ে বেশি, সেখানে তারা অবস্থান করেন পাঁচ মিনিটেরও কম। ফলে তাদের ওপর তেজস্ক্রিয়তার সেরকম প্রভাব একেবারেই পড়েনি।
অন্যান্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যেভাবে নাকচ করে দিল চাঁদের একটি ছবি
অ্যাপোলো ১১ অভিযানের সময় চাঁদের যে স্থানে প্রথমবারের মতো নভোচারীরা নেমেছিলেন সেখানকার বহু ছবি তোলা হয়েছে পরবর্তীতে। চাঁদে পরবর্তীকালে যেসব নভোযান পাঠানো হয়েছে সেগুলো থেকে অ্যাপোলোর ল্যান্ডিং সাইটের সেসব ছবি তোলা হয়েছে। নাসা সেসব ছবি প্রকাশও করেছে।
ভিন্ন একটি নভোযান ২০০৯ সাল থেকে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছে। সেটি থেকে অ্যাপোলোর ল্যান্ডিং সাইটের তোলা ছবি স্পষ্টই প্রমাণ করে যে চাঁদে আসলেই মানুষ নেমেছিল।
সেই নভোযানের ছবিতে স্পষ্ট, অ্যাপোলো-১১ যেখানে নেমেছিল, ঠিক সেখানকার কিছু ছবিতে ওই অভিযানের অনেক প্রমাণ রয়েছে। চাঁদের মাটির ওপর ছাপ ছাড়াও আছে লুনার মডিউলের পড়ে থাকা অংশ।
পরবর্তীকালে নানা অভিযানে ছয়জন মার্কিন নভোচারী চাঁদে যে মার্কিন পতাকা গেড়ে এসেছিলেন, সেগুলো এখনো আছে। সেই পতাকার ছায়াও ধরা পড়েছে ছবিতে। তবে একটি পতাকা আগের জায়গায় নেই। বাজ অলড্রিন জানিয়েছেন, তাদের লুনার মডিউল যখন ফিরে আসার জন্য চাঁদের বুক থেকে উঠছিল, তখন ইঞ্জিনের নির্গত ধোঁয়ায় সেটি পড়ে যায়।
সোভিয়েতরা কেন বিশ্বাস করল মার্কিন চন্দ্রবিজয় ?
চাঁদে মার্কিন অভিযান বিষয়ে সে সময়ের প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো প্রশ্ন তোলেনি। যদি মার্কিনীরা সত্যিই চাঁদে না গিয়ে থাকে, তাহলে সোভিয়েতরা কেন এরকম একটি সাজানো ঘটনায় বিশ্বাস করবে?
ওপরে বর্ণনা করা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতিটি প্রশ্নই অসার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও এগুলোতে এখনো বিশ্বাস করে অনেক মানুষ।
১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন- এটি বিশ্বাস করতে চান না অনেকেই।
যারা চন্দ্রবিজয় সম্পর্কে নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ান, তাদেরকে একটা প্রশ্ন সব সময় করা হয়। যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তীব স্নায়ু যুদ্ধ আর চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে তারা কেন মার্কিনীদের সাজানো ঘটনা মেনে নেবে?
এ বিষয়ে নাসার সাবেক ইতিহাসবিদ রবার্ট লনিয়াস বলেন, ‘আমরা যদি চাঁদে না গিয়ে থাকি এবং এরকম নাটক সাজিয়ে থাকি, তাহলে সোভিয়েতদের তো সেটা ফাঁস করে দেয়ার সক্ষমতা এবং ইচ্ছে দুটিই ছিল।
‘কিন্ত এ বিষয়ে তারা তো একটি শব্দও বলেনি। সেটাইতো চন্দ্রবিজয়ের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ।