গুদামের চাল নিয়ে চলে তুঘলকি কান্ড!

85

কৃষকের কাছ থেকে সরকারের সংগৃহীত চালের মূল্য ৩৬ টাকা। এ দরে সংগৃহীত চালগুলো দেওয়ানহাট ও হালিশহরের কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদাম (সিএসডি) এবং বিভিন্ন স্থানীয় খাদ্য গুদামে (এলএসডি)’ সংরক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। আনা-নেওয়ার এই পথেই চাল নিয়ে চলে তুঘলকি কান্ড। ডিও ব্যবসায়ী, পরিবহন ঠিকাদার ও খাদ্য বিভাগের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে গুদামের চাল চলে যায় খোলাবাজারে। আর সরকারের সংগৃহীত ভালোমানের চালের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিও ব্যবসায়ীদের সংগৃহীত নিম্নমানের পঁচা-নষ্ট চালগুলোই হালিশহর ও দেওয়ানহাট গুদামে ঢুকানো হয়।
এমন তথ্যের ভিত্তিতেই গত ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামে সফরকালে দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্য গুদামের দশটি গুদাম সিলগালা করে দেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। পরে তদন্ত কমিটি এর সত্যতা না পেয়ে গুদামগুলো খুলে দেন। তবে নির্ধারিত সময়ে চাল খালাসের কথা থাকলেও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ডিও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘসময় ধরে চাল রেখে দেন বলে অভিযোগ উঠে। আর এসব নিয়ন্ত্রণে দুটি সিএসডিতেই গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র। এর আগে ২০১৭ সালে পাচার করার সময় সাতটি ট্রাকসহ ১৫৫ মেট্রিক টন সরকারি চাল জব্দ করেছিল র‌্যাব। এ ঘটনায় খাদ্য কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত এ ঘটনার পর খাদ্য বিভাগের শক্তিশালী সিন্ডিকেট কর্তৃক চাল পাচারের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
দেওয়ানহাট খাদ্য গুদামের সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ বেলাল পূর্বদেশকে বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ থেকে সরকারের সংগৃহীত
চালগুলো খোলা বাজারে যায় না। ডিও ব্যবসায়ীরা যেসব চাল ক্রয় করেন সেগুলোই খোলা বাজারে বিক্রি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জন্য বরাদ্দ হওয়া চালগুলোই মূলত ডিও ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে। সরকারের কেনা ডিও অনুযায়ী সব চাল গুদামে আসে। আর চালগুলো গুদামে ঢুকার আগে চুঙা মেরে নিশ্চিত হয়েই সংরক্ষণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বাষ্পের কারণে চালের আকারে কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। এ কারণেই অনেকেই চালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে। প্রকৃত পক্ষে গুদামে আনা সরকারের সংগৃহীত চালগুলোর মান অত্যন্ত ভালো।’
জানা যায়, সরকারের সংগৃহীত চালগুলো সিএসডি-এলএসডি হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হলেও মূলত চালের পরিবর্তে নগদ অর্থই লেনদেন হয় বেশি। খাদ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ১০টি নির্দেশনা মানার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন (সিআরটিসি) ও বিভাগীয় সড়ক পরিবহনের (ডিআরটিসি) কয়েকজন ঠিকাদার খাদ্য বিভাগের চাল নিয়ে নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিটি সিআরটিসি সূচিতে ১৫-২০ ট্রাক ও ডিআরটিসি সূচিতে ৮-১০ ট্রাক চাল পরিবহন করা হয়। উত্তর বঙ্গের দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রংপুর থেকে আটাশ, উনত্রিশ, পাইজাম, লোকাল বাসমতি চাল সংগ্রহ করা হয়। এসব চালের দাম খোলা বাজারে বেশি হওয়ায় চালগুলো ধরে রেখে নি¤œমানের চাল গুদামে ঢুকানো হয়। এরমধ্যে নোয়াখালী ও সিলেট থেকে সংগৃহীত নি¤œমানের চালও আছে। আলম সওদাগর ও শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট এ কারসাজিতে যুক্ত। এছাড়াও আপন ট্রেডার্সের ফজলে রাব্বী টিটু, জাহিদ পরিবহনের জাহিদ হোসেন চাল পরিবহনে কারসাজির নিয়ন্ত্রক। ডিও ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে চাল খালাস না করে দীর্ঘদিন গুদামে চাল রেখে দেয়ার অভিযোগ আছে। ডিও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামে প্রতিকেজি চাল ১৬ টাকা ও পাবর্ত্য অঞ্চলে ১২-১৬ টাকায় ক্রয় করেন। ভালো মানের চালগুলো রেখে দিয়ে কম দামে ডিও কেনা চালগুলোই গুদামে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আলম সওদাগর মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন বড় বড় দপ্তরের অনুকূলে বরাদ্দ হওয়া চালগুলো কিনে নেন। তার সাথে বড় বড় কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক আছে। মূলত এ সুযোগেই তিনি সিএসডিতে নিজেকে প্রভাবশালী ভাবেন।’
এ বিষয়ে জানতে আলম সওদাগরের মুঠোফোনে কয়েকবার কল দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তবে আপন ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী ফজলে রাব্বী টিটু পূর্বদেশকে বলেন, ‘চিলে কান নিয়ে গেছে আমরা চিলের পিছে দৌড়াচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে কানটা আছে কিনা সেটি দেখি না। এরকম কোনও কিছু আমার নলেজে নাই। কিছু মানুষ কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সিন্ডিকেট টুকিটাকি উনিশ-বিশ করবে অনেকেই। তবে সবগুলোর ডিও আছে। ডিও’র বিপরীতে ব্যবসা করছে। এটাকে ভিন্নভাবে বলছে এদিকের পণ্য সেদিকে নেয়া হচ্ছে। এখানে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারের ডিও আছে। সেখানের লোকগুলো দেখা যায় পাহাড়তলী, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইয়ে চাল বিক্রি করছে। সেখানকার গুদাম থেকে চাল এনেই বাজারজাত করছে। এটাকেই বাইরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে।’
খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার ১০০টি উপজেলায় তিনটি সিএসডি, দুটি সাইলো ও ১১৫টি এলএসডি আছে। এরমধ্যে হালিশহর ও দেওয়ানহাট খাদ্য গুদাম ঘিরেই দেশের খাদ্য ঘাটতির যোগান দেয়া হয়।