গুগল অ্যাপগুলোর ওপর কতটা নির্ভরশীল আমরা?

131

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্মার্ট ফোন কোম্পানি হুয়াওয়ে গুগলের কিছু সফটওয়্যার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরে ভালোই বিপদে পড়েছে। গুগলের ভীষণ জনপ্রিয় কয়েকটি অ্যাপ- ইউটিউব, গুগল ম্যাপ, জিমেইল এর মত অ্যাপগুলোর ওপর মানুষ কতটা নির্ভরশীল, তার ওপর নির্ভর করছে এই চীনা কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে হুয়াওয়েকে এমন একটি তালিকায় রাখা হয়েছে যে তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন আমেরিকান কোম্পানি লাইসেন্স ছাড়া বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। গুগলের এ সিদ্ধান্তের ফলে হুয়াওয়ে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের কিছু আপডেট করতে পারবে না এবং কয়েকটি গুগল অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে না।হুয়াওয়ে তরতর করে সামনে আগাচ্ছিল, সম্প্রতি স্মার্টফোন বিক্রিতে হুয়াওয়ে জনপ্রিয় মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপলকেও ছাড়িয়ে যায়। মোবাইলে গুগল অ্যাপ ব্যবহার করতে না পারলে মানুষ কতটা গ্রহণ করবে ওই ফোন, বা আদৌ করবে কিনা এ নিয়ে ভাবছেন এই চীনা প্রতিষ্ঠানটি।
চীনে হুয়াওয়ে ব্যবহারকারীদের ওপর গুগলের নিষেধাজ্ঞার তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে পৃথিবীর বাকি সব দেশে, যেখানে গুগল ছাড়া মানুষ চলতেই পারে না, সেখানে এ নিষেধাজ্ঞার কারণে হুয়াওয়ের স্মার্টফোন বিক্রিতে বেশ ভাটা পড়বে।
২০০৬ সালে ইউটিউব কিনে নেয় গুগল। ইউটিউব এতটাই জনপ্রিয় যে এটি একটি নতুন পেশার সৃষ্টি করেছে। যার নাম ইউটিউবার। আপনি যদি কম্পিউটারে গেইম খেলায় বেশ দক্ষ হন, কিংবা ভালো মেকআপ করতে পারেন অথবা অন্য কোনো কিছু শেখান— লাখ লাখ লোক আপনার ভিডিও দেখতে পারে, আপনার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে পারে আর রাতারাতি আপনি হয়ে যেতে পারেন কোটিপতি!
ফোর্বস ম্যাগাজিন এর প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর শীর্ষ ১০ ইউটিউবার মোট ১ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। মানুষের খ্যাতি ও অর্থের বাসনাকে প্রভাবিত করে ভালোই কামিয়েছে ইউটিউব। তবে এই একটি ক্ষেত্রেই গুগলকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মার্কেটিং কোম্পানি সেন্সর টাওয়ারের হিসাব মতে, ২০১৮ সালে যে অ্যাপগুলো সবচেয়ে বেশি ডাউন লোড করা হয়েছে তার মধ্যে তিন নম্বরে রয়েছে টিকটক। ২০১৬ সালে প্রথম এই অ্যাপ বাজারে আসে। এ অল্প কদিনেই টিকটক নিয়মিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটিতে পৌঁছেছে। বাইটড্যান্স নামের এক চীনা কোম্পানি প্রথমে ডোয়িন নামে এ অ্যাপ চালু করে। এখনো চীনে এ অ্যাপ ডোয়িন নামেই পরিচিত।
এ অ্যাপ ব্যবহার করে আপনি খুবই ছোট দৈর্ঘ্যের ভিডিও বানাতে পারবেন। ইউটিউব তো বটেই, এটি ইনস্টাগ্রামের জনপ্রিয়তাকে আরো বেশি হুমকির মুখে ফেলেছে। আবার এটিও প্রমাণ করেছে যে মানুষের রুচি কত দ্রæত বদলে যেতে পারে।
ইউটিউব এখন গুগলের বেশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। প্রায় ১৮ কোটি লোক ইউটিউব ব্যবহার করে। তবে এ চিত্র পাল্টে যাওয়াও অসম্ভব কিছু না। নতুন নতুন প্রতিদ্ব›দ্বীর আবির্ভাবের ফলে এই অ্যাপও হয়ত একদিন তার জনপ্রিয়তা হারাবে।
এর একটি বড় কারণ এর কোনো ভালো বিকল্প না থাকা। ২০১২ সালে অ্যাপল তাদের নিজস্ব ম্যাপ তৈরি করেছিল বটে, তবে সেটি বিস্তারিত তথ্যের অভাব ও ভুলভাল দিকনির্দেশনার কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ম্যাপ নিয়ে সমস্যা এতই প্রকট হয় যে, অ্যাপল তাদের ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তাদের ম্যাপ ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করে।
এক জরিপে জানা গেছে, ৬৯ শতাংশ আইফোন ব্যবহারকারী অ্যাপলের ওই অ্যাপের চেয়ে গুগল ম্যাপ বেশি পছন্দ করে। তবে সার্চ ইঞ্জিনের মতই, চীনে গুগল ম্যাপের তেমন জনপ্রিয়তা নেই। চীনে বাইদুর ম্যাপিং সফটওয়্যারই বেশি জনপ্রিয়।
বাইদুর নতুন ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড ম্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি। তারা চীনের বাইরেও তাদের জনপ্রিয়তা তৈরি করতে চায়। তারা হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ গুগল অ্যাপগুলোর বিকল্প হিসেবে তাদের অ্যাপগুলো ব্যবহারের প্রস্তাব দিতে পারে।
এতদিন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছে দুইটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য আইওএস আর অন্য ডিভাইসগুলোতে অ্যানড্রয়েড ব্যবহার করা হত। হুয়াওয়ের ওপর গুগলের এই নিষেধাজ্ঞার পরে হয়ত তৃতীয় কোনো অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আসতে পারে।
আমেরিকান প্রশাসন আমাদের শক্তিকে খাটো করে দেখছে। আমরা আমেরিকান সফটওয়্যার ছাড়াই চলতে পারি। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একথা বলেছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেই। হুয়াওয়ে আমেরিকার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরেমি থম্পসন বলেছেন, আমরা নতুন পরিকল্পনা করছি। তবে সেটা কী হবে তা এখনই বলা যাবে না। আমরা নতুন বিকল্প তৈরির চেষ্টা করছি। যেটা আমাদের ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে।
হুয়াওয়ে নতুন বিকল্প তৈরি করা মানে অ্যাপল ও অ্যানড্রয়েডের বাইরে আরো কিছু প�্যাটফর্ম তৈরি হওয়া। তবে এই প্রতিযোগিতায় কে জিতবে তা বলা মুশকিল। এই চীনা কোম্পানি হয়ত তাদের নিজের দেশের বাজার ও সরকারের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করবে।
আরেক আমেরিকান জায়ান্ট টেক কোম্পানি মাইক্রোসফট একসময় আমেরিকার মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেমের ৪২ শতাংশ দখল করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা বাজারে টিকতে পারেনি। এক সময়ের জনপ্রিয় মোবাইল নির্মাতা কোম্পানি নোকিয়া কিনে তারা তাদের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল যা পরে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

অ্যাপ ব্যবহারে অনাগ্রহ
বাড়ছে বাইক চালকদের

বিবিসি বাংলা
মানিকগঞ্জের মোহাম্মদ আলী একসময় ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে চাকরী করতেন। সব মিলিয়ে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৮০০০ টাকা। নিরাপত্তারক্ষীর চাকরী করা অবস্থাতেই তিনি বুঝতে পারেন, ঢাকায় বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে মোটরসাইকেলের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন বেশ লাভজনক।
তখন তিনি কাজের ফাঁকে-ফাঁকে মোটরসাইকেল চালানো শিখে নেন। এরপর নিজের কিছু জমানো টাকা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে একটি মোটর সাইকেল ক্রয় করেন। গত এক বছর যাবত এই মোটর সাইকেল চালিয়ে তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন।
মোহাম্মদ আলীর দাবি, শুরুর দিকে তার প্রতিমাসে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় হলেও গত কয়েকমাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে। মো. আলী এখন চেষ্টা করেন অ্যাপ এড়িয়ে কিভাবে চুক্তি-ভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করা যায়। ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডে দাঁড়িয়ে যাত্রী খুঁজতে দেখা গেল মোহাম্মদ আলীকে।
তিনি বলেন, অ্যাপের প্রতি তার অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত, সারাদিনে তিনি যা উপার্জন করেন তার ২০ শতাংশ দিয়ে দিতে হয় রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে। যদি তিনি অ্যাপ ব্যবহার না করেন তাহলে সে টাকা তার পকেটেই থাকবে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ঢাকায় এখন প্রচুর মোটরসাইকেল হওয়ায় আগের চেয়ে অ্যাপ এর মাধ্যমে কল আসে কম। ফলে অগত্যা রাস্তায় যাত্রী খুঁজে নিতে হচ্ছে।
আজ সকালে আটটার সময় শুরু করছি। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। মাত্র ১২০ টাকার একটা কাস্টমার পাইছি। অ্যাপে কল আসেনা, বলছিলেন মোহাম্মদ আলী। ঢাকার রাস্তায় মোহাম্মদ আলীর মতো অনেক মোটরসাইকেল চালক আছেন যারা এখন অ্যাপ এড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে আগ্রহী।
তিনি বলেন, কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে যে ২০ পার্সেন্ট কেটে নিচ্ছে এটা একটু বেশি হয়ে যায়। এটা ১০ পার্সেন্ট হলে মোটামুটি চলে। দেখা যায় আমরা যা কামাই বেশিরভাগ ওদের দিতে হয়।
অ্যাপ-ভিত্তিক মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীদের বিড়ম্বনা দিনকে দিন বাড়ছেই। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন আসিয়া আলম দিনা। অফিসে যাতায়াতের জন্য মোটর সাইকেল এখন তাঁর নিত্য সঙ্গী। কিন্তু অ্যাপের মাধ্যমে মোটর সাইকেল এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানালেন মিজ দিনা।
সৈনিক ক্লাব থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত ওরা ভাড়া চায় ১০০ টাকা। দেখা যাচ্ছে, যদি ডিসকাউন্ট থাকে তাহলে আপনি ৪০-৫০ টাকায় চলে যেতে পারেন। অ্যাপ ইউজ করলে কেউ অ্যাকসেপ্ট করতে চায়না, বলছিলেন মিজ দিনা।
যাত্রীদের অভিযোগ হচ্ছে, মোটরসাইকেল চালকরা এখন রিকশাচালক কিংবা সিএনজি-চালিত স্কুটার চালকদের মতো আচরণ করছে। রীতিমতো দরদাম করে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে তাদের। আরেকজন যাত্রী ফারিহা রহমান বলেন, রাইড শেয়ারিং যে কনসেপ্ট থেকে শুরু হয়েছিল, এখন মনে হয়না সেটা চলছে।
তিনি বলেন, অ্যাপ-এর মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন হলে সেটি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কারণ, সেখানে ড্রাইভারের নাম, ছবি এবং মোটরসাইকেল নম্বর থাকে। এ বিষয়টি যাত্রীদের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ তৈরি করে। ফারিহা আলম বলেন, যদি অ্যাপ-এর মাধ্যমে যান তাহলে ওটা ট্র্যাক করে। পরবর্তীতে কোন অঘটন ঘটলে স্টেপ নিতে পারবেন।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও এর প্রধান নির্বাহী হুসেইন এম ইলিয়াস বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত আছেন। যেসব মোটরসাইকেল চালকদের বিভিন্ন সময় বাদ দেয়া হয়েছে তারা এ কাজ বেশি করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।