কালো ঘাড়-বেনে বউ

271

বাংলাদেশে কাম্যস্তরে বনভূমি না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সামাজিক বনায়ন বেড়েছে। পাশাপাশি ইট পাথরের নগরে ছাদবাগান গড়ে তোলার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে নগরে পাখির আনোগোনাও বাড়ছে। আমার ফ্ল্যাটের পাশের বাড়ির ছাদে এমনি একটি ছাদবাগান আছে। তাতে কামরাঙা, বিলেম্বু, পেয়ারা, সফেদা, লেবু, মেহেদিসহ নানা জাতের সবজি ও ফুল বাগান গড়ে তোলে বাড়ির মালিক। আমার লনেও আছে নানাবিধ তরুলতা। পামের বাড়ির ছাদ বাগানের ছায়াঘন পরিবেশে মাঝে মাঝে এমন কিছু পাখি দেখি, যারা শহরে থাকার কথা নয়। বিশেষ করে শীত মৌসুমে। পাখিদের স্বভাব হচ্ছে ডাকাডাকি করা কিংবা আমুদে মেতে থাকা। এদের ডাক শুনেই সনাক্ত করার চেষ্টা করি পাখিটি চিহ্নিত করার।
এবার গণমাধ্যমে জানতে পারি অক্টোবরের শুরুতেই ভারতের হিমাচল ও কাস্মীরে আগে বরফ পড়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে খঞ্জনা এসে গেছে বাংলাদেশে। অপেক্ষায় থাকি নতুন নতুন পাখি দেখার। এমনি এক ভোরে নতুন এক ধরনের ডাক শুনে ঘুম ভাঙে। গিন্নি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। ঘুমের রেশ কাটতে না কাটতেই সেই পাখিটি উড়ে চলে যায়। দু-তিন দিন পর ভোরে আবার সেই পাখিটির ডাক শুনতে পাই। দেখে চমকে উঠি। আরে এ পাখি তো শহরে দেখার কথা নয়! এর আগেও জামালখান এলাকায় নতুন পাখি দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। যে পাখিটি দেখালাম সে হলো কালোঘাড়-বেনে বউ (ইষধপশ-হধঢ়বফ ঙৎরড়ষব) বৈজ্ঞানিক নাম (ঙৎরড়ষব ঈযবহংরং) এরা যখন শিষ দেয় তখন হুয়িও, হুয়িও শব্দ করে আর গান গায় তখন ট্যারিও, ট্যারিও শব্দ করে। এদের গানে মুগ্ধতা আছে। বাংলাদেশে চার প্রজাতির বেনে বউ দেখা যায়। দেশি সোনা বেনে বউ ও কালোমাথা বেনে বউ আমাদের স্থানীয়। আর তামা রঙ বেনে বউ ও কালোঘাড়-বেনে বউ পরিযায়ী।
কালো ঘাড় বেনে বউ আকারে শালিকের মতো। দেহ হলদে, চোখ লাল, চঞ্চু, লালচে-গোলাপি। চোখ থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত কালো মোটা দাগ। ডানা ও লেজের পেছনের অংশ কালো। পুরুষের দেহ উজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী পাখির দেহের রঙ অন্জ্জ্বুল হলুদ। অপ্রাপ্ত বয়সী পাখির দেহ সবুজ এবং পেটে কালো দাগ। শীতের সময় চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকার বনে মাঝে মাঝে দেখা যায়।
এরা লাজুক পাখি। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। তবে লোকালয়ে শহরে বন্দরের ঘন গাছপালা ভরা বাগানে এদের মাঝে মাঝে দেখা মেলে। বড় গাছের ঘন পাতার আড়ালে থেকে যখন উড়ে যায়, মনে হয় যেন সোনালি বিদ্যুৎ ঝলসে উঠলো। এদের উড়া-উড়ি ভঙ্গি ও অদ্ভুত। উড়তে উড়তে মাঝে মাঝে হঠাৎ গোঁক্তা খেয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। এর ডুমুর বট ও ছোট খাট ফল খেতে ভালবাসে। তাছাড়া নানা রকম কীটপতঙ্গ এবং শিমুল, পলাশ ও মাদার প্রভৃতি ফুলের মধু খেয়ে থাকে। গাছের বাকলের ভেতরের আঁশ, পালক, ঘাস, তত্ত দিয়ে সুন্দর করে বাটির মত বাসা বোনে। আর সে বাসায় মাকড়সার জাল দিয়ে প্রলেপ দেয়। গাছের দু-মুখো ডালের মাঝে, মাটি থেকে ৪-১০ মিটার উচ্চতায় দোলনার মতো ঝোলানো বাসা বোনে। এদের ডিমের সংখ্যা ২ থেকে ৪টি। রঙ গোলাপি সাদা, তার উপর কাল, খয়েরি ছিট থাকে। বাবা-মা দুজনেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে ১৩ থেকে ১৫ দিন লাগে। পৃথিবীতে ২৪ প্রজাতির বেনে বউ পাখি আছে। এরা সাহসী ও বুদ্ধিমান পাখি।
লেখক-কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)