‘কক্সবাজার ঘোষণায়’ স্থান পেয়েছে যেসব বিষয়

20

কক্সবাজার ঘোষণার মধ্যদিয়ে শেষ হওয়া বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সংলাপে দুই দেশের অংশগ্রহণকারীরা তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বলানি খাত, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকট মোকাবেলা ও আঞ্চলিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমন্বিত পরিকল্পনাসহ সম্ভাবনাময় বিভিন্ন খাতের সার্বিক উন্নয়ন বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
এছাড়া বিশ্বের জন্য এমন একটি কৌশলগত অবস্থান তৈরি করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যেখানে ভীতি থেকে মুক্তি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার আরও স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশ নিশ্চিত হবে। এছাড়া কৌশলগত অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় মানবাধিকার ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে, সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করার বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ-ভারত দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে।
কক্সবাজারের ইনানীর তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপের বলরুমে গত শুক্রবার শুরু হওয়া সংলাপ শনিবার শেষ হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর রিজিয়নাল স্টাডি এবং ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ও ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ গত শুক্রবার ও শনিবার বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সংলাপ-এর আয়োজন করে। সংলাপে ভারতের ২৬ জন এবং সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ বাংলাদেশের ৫৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
সমাপনী সেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে শুধু আশ্রয় নয়, জীবন ধারণের সব উপকরণ সরবরাহ করে পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। এ কারণেই শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি উপাধি পেয়েছেন। তাদেরকে দীর্ঘদিন রাখা আমাদের জন্য ভোগান্তির। বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। এটি তাড়াতাড়ি করতে ভারতসহ বন্ধুপ্রতীম অন্য দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের চাপ প্রয়োগে এটিই উপযুক্ত সময়।
বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত অবস্থান বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি হিসেবে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ আলোচিত হয়। সন্ত্রাসবাদের স্থান বাংলাদেশে নেই। শেখ হাসিনার সরকার জিরো-টলারেন্স নীতিতে এটি দমন করছে।
আবদুল মোমেন বলেন, ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ-ভারতের স¤পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং ঐতিহ্যময়। এ স¤পর্কের সূত্র ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সাড়া দিয়ে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে নরেদ্র মোদির সরকারও আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েই পাশে রয়েছে। আমরা ভারতের এই ত্যাগের কথা কোনদিন ভুলব না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, গভীর বন্ধুত্বের কারণে ভারত আমাদের প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সবদিক দিয়েই সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। উন্নয়নে আমরা সহযোগী হিসেবে পাচ্ছি নেপাল-ভুটানসহ প্রতিবেশী অন্যদেশগুলোকেও। দুই দেশের বিরাজমান সমস্যাগুলো সুনির্দিষ্ট করে, তা নিরসন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে বন্ধুত্ব সংলাপ সেতুর মতো ভূমিকা রাখছে।
আবদুল মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুড গভর্নেস তৈরিতে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে তাঁর সরকার অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পেয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান।
এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টেকনো ইন্টারন্যাশরাল কলেজ অব টেকনোলজির পরিচালক ড. রাধা তমাল গোস্বামী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের উন্নত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ স¤প্রতি ত্রিপুরায় গ্যাস সরবরাহ এবং মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে ভারত সরকার খুবই খুশি। তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিখাত, আঞ্চলিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তাসহ সবদিকের উন্নয়নে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।
শক্তিশালী আঞ্চলিক নিরাপত্তা সেশনে বক্তারা বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক সময় সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারে ধর্মকে পুঁজি করে কার্যক্রম চালানো দলগুলোর কার্যক্রম কঠোর নজরে রাখা দরকার।
ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা উচ্চতায় রয়েছে দাবি করে বক্তারা আরো বলেন, তরুণদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার সম্ভব। বর্তমান সময় প্রযুক্তির। সন্ত্রাস ছড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। তাই প্রযুক্তিকে অপব্যবহার রোধে একসাথে কাজ করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে এবং অপরাধ দমনে সফলতাও পাচ্ছে।
উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় দেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গার বিষয়ে বক্তারা বলেন, প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আঞ্চলিক সন্ত্রাসের বিস্ফোরক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি এ অঞ্চলের কোনো দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
প্রতিবেশগত টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক সেশনে বক্তারা বলেন, বিশ্ব পর্যটনের প্রসারতা বেড়েছে। এরই মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব। দেশের সমুদ্র-পাহাড় স¤পদের ব্যবহারে যত্নবান হওয়া দরকার। পরিবেশের ক্ষতি না করে প্রতিবেশগত টেকসই উন্নয়নে ইকোনোমির পথে হাঁটতে দুই বন্ধুপ্রতীম দেশকে একীভ‚ত হয়ে কাজ করতে হবে।
টেকনোলজি, পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সেশনে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেন, প্রযুক্তিতে দ্রুত এগুচ্ছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হচ্ছে সফলতা। বলতে গেলে সব সেক্টরে সফলতার গল্প তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা।
নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির প্রচেষ্টার পাশাপাশি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ চলছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য আবদুল আজিজ খান।
ভারতের রাজ্যসভার বিধায়ক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক এমজে আকবর বলেন, চলমান সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ, যা গত ২৫ বছরের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশ সব দিক দিয়ে দ্রæত এগুচ্ছে। প্রতিবেশী হিসেবে দুই দেশের সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ রাখা দরকার। দুই দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোর যতœ নিয়ে দুই দেশের জনসাধারণের উপকারে ব্যবহারের উপযোগী রাখা জরুরি। এতে অর্থনৈতিকভাবে দুই দেশই লাভবান হবে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে কাজ করা জরুরি।
সমাপনী বক্তব্যে সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক অলক বানশাল, কক্সবাজারের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বক্তব্য দেন। অন্য সেশনে বক্তব্য দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আলী শিকদার, সংসদ সদস্য ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ দুই দেশের অংশগ্রহণকারীরা।
সমাপনীতে এ সময় ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ স¤পাদক রাম মাধব বারানাসী, ফ্রেন্ড বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর রিজিয়নাল স্টাডির চেয়ারম্যান আ. স. ম. শামসুল আরেফীন, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সমাপনী অধিবেশনে নয়টি সুপারিশসহ কক্সবাজার ঘোষণা করা হয়েছে। গত শুক্রবার দু’দিন ব্যাপী এ সংলাপের উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।