আবারও বাড়ছে বন্দী

48

নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ের মত ব্যাপকহারে পুলিশের ধরপাকড় নেই। তবুও এক হাজার আটশ’ ৫৩ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফের উপচে পড়া অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ গুণেরও বেশি বন্দীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। রাজনৈতিক মামলায় আসামি হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের আদালতে আত্মসমর্পণের হার বেড়ে যাওয়ায় কারাগারে বন্দীর চাপ ফের বেড়েছে।
বন্দীরা বলছেন, শুধুই উপচে পড়া নয়, আবাসন ব্যবস্থা রীতিমত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া, গোসল ও ঘুম নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই তাদের।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ১০ হাজারের ঘর ছুঁতে চলেছে। গত শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ‘লকআপ’ শেষে মোট বন্দী ছিলেন নয় হাজার সাতশ’ ৪৮ জন। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক বন্দী আদালত হয়ে কারাগারে এলেও সেই তুলনায় জামিনে মুক্তি মিলছে না। তাই ফেব্রুয়ারির শুরুতে কারাভ্যন্তরে খানিকটা সহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হলেও সম্প্রতি তা ফের নাজুক হতে চলেছে। রাজনৈতিক মামলার আসামিরাই এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কারাগারে আসছেন।
নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় ‘নাশকতার’ অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় উচ্চ আদালতের অন্তর্বর্তী জামিন আদেশের মেয়াদ শেষে এসব মামলার আসামিরা অনেকটা নিয়মিতভাবেই নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণ করছেন। আত্মসমর্পণকারীরা স্থায়ী জামিন চেয়ে আবেদন করলেও ওইদিনই তা মঞ্জুর হচ্ছে না। তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়া হচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম পক্ষে এ ধরনের দেড় ডজনের বেশি মামলায় অভিযুক্তরা আদালতে আত্মসমর্পণের পর কারাগারে গেছেন। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি নাশকতার মামলায় বিএনপির ৩১ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা।
এদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন জিয়া। নগরীর সদরঘাট থানার ছয়টি নাশকতার মামলায় বিএনপির ওই নেতাকর্মীরা উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে যাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা এবং যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রয়েছেন।
এর আগের দিন ১০ ফেব্রুয়ারি নাশকতার আরেক মামলায় বোয়ালখালী পৌরসভার মেয়র এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক হাজী আবুল কালাম আবুকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন একই আদালত। তিনিও উচ্চ আদালতের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
কারাগারের ডেপুটি জেলার আবদুস সেলিম পূর্বদেশকে বলেন, ‘কারাগারের বন্দীরা তো আর স্থায়ী বাসিন্দা নন। ধারণ ক্ষমতা যাই থাকুক না কেন, তার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দী থাকা নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু সময়ে সময়ে বন্দী বাড়ে এবং কমে। কখনও কখনও অতিরিক্ত চাপও আমাদের সামলাতে হয়। তখন জেলকোড মেনে বন্দীদের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। এখন চাপ বেড়েছে। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
কারাসূত্র জানিয়েছে, কারাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত বছরের শেষেদিকেই কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বন্দীর চাপ নিতে হয়েছে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পাঁচ গুণেরও বেশি বন্দীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের মূল ভবনে তৈরি করা কক্ষগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দা ও চৌকাতে (রান্নাঘর) পর্যন্ত বন্দীদেরকে রাখতে হয়েছে। মূলত বিদায়ী বছরের শুরুতে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর চাপ বাড়তে থাকে। তার আগে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বন্দী থাকলেও গত ২০ ডিসেম্বর এসে বন্দীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
এরপর নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মামলায় আটকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এক হাজার আটশ’ ৫৩ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরদিন অর্থাৎ সদ্যবিদায়ী বছরের শেষদিন বন্দী ছিল ১১ হাজারের প্রায় কাছাকাছি ১০ হাজার নয়শ’ জন। এতে গাদাগাদি অবস্থা সৃষ্টি হয় কারাভ্যন্তরে। এরপর চলতি বছরের শুরুতে ছুটি শেষে আদালতের কার্যক্রম চালু হলে রাজনৈতিক মামলার আসামিদের জামিন মঞ্জুরের হার তুলনামূলকভাবে বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে পয়লা জানুয়ারি সর্বনিম্ন ৬৪ জন এবং ৮ জানুয়ারি সর্বোচ্চ তিনশ’ চার জন বন্দী জামিনে মুক্তি পান।
বন্দী পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে গত ৬ ডিসেম্বর কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল হাসান স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সেসময় বন্দীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় নয় হাজার পাঁচশ ৯২ জন। আর কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দীর সংখ্যা দেখানো হয় তিন হাজার নয়শ ৭৫ জন। অথচ এই দুই কারাগারে সর্বমোট বন্দীর ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে দুই হাজার তিনশ ৮৩ জন।
নির্বাচনকে ঘিরে এ সংখ্যা আরও বাড়লে সমস্যা প্রকট হতে পারে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণ ক্ষমতার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত বন্দী আটক থাকায় বন্দীদের আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অপরাধীর ধরন অনুযায়ী বন্দীদের আলাদা করে রাখার নিয়ম থাকলেও আবাসন সমস্যার কারণে মাদকাসক্ত, বয়স্ক বন্দী ও উগ্রবাদী কর্মকাÐে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত বন্দীদের আলাদা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কারাগারের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে।
এছাড়া বন্দীদের সাথে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে সমস্যাসহ নানা রকম সংকটের উদ্ভব হচ্ছে। এই সুযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে তাতে উল্লেখ করা হয়।
আদালত সূত্র জানায়, বিগত ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নগর ও জেলার ৩২ থানায় ‘নাশকতার’ অভিযোগে মামলা হয়েছে মোট দুইশ’ ৩২টি। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর মাসেই হয়েছে একশ’ তিনটি মামলা। তার মানে অক্টোবরে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ কিংবা নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। তবে গণমাধ্যমে সে সময় এমন কোনও ঘটনার খবর প্রকাশ বা প্রচারিত হয়নি।
আদালতের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবরে একশ তিনটি ছাড়াও সেপ্টেম্বরে ৪৭ ও নভেম্বরে ২৫টি নাশকতার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করেছে পুলিশ। এসব মামলায় নির্বাচনের আগে যারা গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন, তারা এখন হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে এসে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করছেন।