আকাশে উড়ুক মুক্ত পাখি

110

সুমন মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। কারো সাতে নেই পাঁচেও নেই। বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সব আদেশ, সব নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে। করবে না কোনো পিতৃহীন সুমনের মা-ই যে একমাত্র সম্বল আর সুমন ও মায়ের যেনো বুকের ধন।
সেই শিশুকালেই সুমন বাবাকে হারিয়েছে। বাবা কারো চিরদিন বেঁচে থাকে না। কিন্তু তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি বাবা কেন পরপারে চলে গেলেন! মায়ের কাছে জানতে চেয়েও এর সঠিক উত্তর পায়নি সুমন। মা বলেছেন, তুই আরো বড়-হ-তখন আস্তে আস্তে সব জানতে পারবি। সুমন মায়ের কথা শুনে হাসে। মনে মনে বলে মা- আমি আর কতো বড় হব-কত বড়ো।
সুমন অষ্টম শ্রেণীর ফাস্ট বয়। তার আরেকটি সুন্দর ফুটফুটে বোন অছে। যার নাম টিসা। টিসা এবার ক্লাস টু’র ছাত্রী। টিসাকে খুব ভালবাসে সুমন। তার এই বোনটিকে কখনো চোখের আড়াল হতে দিতে চায় না সে। টিসার প্রতি সুমনের ভালবাসা-আদর আর গভীর টান দেখে মা এই ছেলেকে নিয়ে আশান্বিত হয়। আশায় বুক বাঁধে। সুমন তার স্বপ্ন পূরণ করবেই।
সুমন পাড়ার ছেলেদের সাথে খুব একটা মেশেনা। বিশেষতো দুষ্টু ছেলেদের সে সব সময় এড়িয়ে চলে। যতক্ষণ ক্লাস আর স্কুলে থাকবে ততক্ষণই শুধু সে স্কুলের বন্ধুদের সাথে কথা বলে এর বাইরে নয়। বাসায় এসে টিসার সাথে আড্ডা দেবে আর সুযোগ পেলে পুরনো পোষা টিয়া পাখির সাথে খেলায় মেতে উঠবে। এই টিয়েটা সুমনের সিংহ ভাগ সময় কেড়ে নেয়। তাকে আদর অপ্যায়ন থেকে শুরু করে স্নান না করানো পর্যন্ত সুমনের ক্ষান্ত নেই। এই পোষা টিয়েটার প্রতি সুমনের এক ধরনের মায়া বসে গেছে। তাকে দু দন্ড না দেখলে তার লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ হয়ে যায়। টিয়েটির প্রতি তার এই বিশেষ দুর্বলতা দেখে মা-সুমনকে তেমন কিছু বলে না। একদিন গঞ্জের হাট থেকে এক শিকারীর কাছ হতে শিবলু মামা তার জন্যে এই টিয়েটাকে নিয়ে আসে।
টিয়েটিকে দেখে টিসাও সেদিন খুব উৎফুল্ল হয়েছিলো। কিন্তু তার পরেও টিয়েটার উপর একচ্ছত্র অধিকারের ভাগ সে কাউকে দেয়নি। এমন কি আদরের বোন টিসাকেও না। এভাবেই দিন চলে যায় রাত আসে। ধীরে ধীরে সুমন বড় হতে থাকে।
সুমন এবার এস.এস.সি দেবে পুরোদমে তার লেখাপড়ার প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। লেখাপড়ার ব্যস্ততায় আদরের টিয়ে আর টিসার প্রতি খুব একটা সময় দিতে পারে না। মাঝে মধ্যে খেয়াল করে সুমন , টিয়েটি তাকে দেখতে না পেয়ে খাঁচার মধ্যে ছটপট করে। টিসার আদার দিয়েও টিয়েটিকে শাস্ত করতে পারে না। একদিন ভোরে মা অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরী হচ্ছেন। কাজের বুয়া টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিয়েছেন। নাস্তা খেতে মা টিসা ও সুমনকে ডাক দিলেন। সুমন নাস্ত না খেয়েই মাকে ধরে বসলো- মা,আমার টিয়েটিকে খাঁচা থেকে আজ মুক্ত করে দাও? মা বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ছেড়ে দিলে যে সে আকাশে উড়ে যাবে। আর কখনো তাকে পাবিনা। সুমন বললো, জানি মা, তবুও তাকে মুক্ত করে দিতে চাই। আমি চাই ডানা মেলে স্বাধীন হয়ে সে আকাশে উড়ে বেড়াক। সুমনের কথা শুনে মা খুব খুশি হলেন। বললেন, মুক্ত যখন করবি, তখন তোর নিজ হাতেই খাঁচাটা খুলে দে। সুমন ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে খাঁচাটা খুলে দেয়। তার পর টিয়েটিকে হাত দিয়ে একটু হাত বুলিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয় সে। সুমন খেয়াল করে টিয়েটা একটু উড়ে গিয়ে পেছন ফিরে একটু লেজ নেড়ে তাকে অভিনন্দন জানালো। এ দৃশ্য দেখে মা, সুমন ও টিসার মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে গেলো।
সুমন জিপিএ ৫ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এস.এস.সি পাশ করেছে। মা’র ইচ্ছে সুমনকে ডাক্তারি পড়াবে। সুমনও মায়ের ইচ্ছের বাস্তবায়নের জন্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো। কঠোর অধ্যবসায় আর নিয়মানুবর্তিতায় একদিন সুমন ডাক্তারি পাশ করলো। ডা. সুমন একদিন মাকে বললোঃ মা, আজ তোমাকে একটা কথার জবাব অবশ্যই দিতে হবে। মা বললেন, দুর বোকা-তোর একটা কেনো দশটা কথা হলেও জবাব দেবো। তুই যে আমার আদরের ছেলে। একমাত্র আশার প্রদীপ। তোকে কি আমি-…। সুমন বললো, অন্য কিছু না পড়িয়ে মা তুমি আমকে কেন ডাক্তারি পড়িয়েছো, সে কথা জানতে চাই। সুমনের কথায় মায়ের দু’চোখ চিক চিক করে উঠলো। আঁচলে চোখ মুছে মা বললেন, তাহলে শোন-তুই তখন অনেক ছোট তোর বাবা ছিলেন একটি বেসরকারী ফার্মের কর্মকর্তা। একদিন তোর বাবা অফিস থেকে ফিরেই হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ি হলেন। ঔষধপত্র-ডাক্তার ক্লিনিক করতে করতেই তোর বাবা জমানো টাকা সব শেষ। সাহায্যের জন্যে সকলের কাছে দ্বারস্থ হলাম। কেউ সামান্য করতেই তোর বাবার জমানো টাকা সব শেষ। কেউ সামান্য সাহায্য করলেও বাকীরা নানা অজুহতে সটকে পড়লো। এমনকি তোর বাবার প্রিয় বন্ধুরাও। অনেক কষ্টের মধ্যেও তাই তোকে ডাক্তারি পড়িয়েছি। আমি চাই তুই মানুষের সেবা করবি। সুমন পা ছুঁয়ে মাকে সালাম করে বলে, মা-তুমি দোয়া করো, আমি যেনো তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারি।