অটিজমে আক্রান্তরা বোঝা নয়, তারাও সৃজনশীল

56

স্টলের টেবিলের উপর সাজানো হাতে তৈরি হরেক রকম পণ্য। মুক্তা পুতি দিয়ে বানানো হয়েছে রঙিন ফুল, ফল ও ব্যবহারের নানা পণ্য। মেয়েদের শাড়ি থেকে শুরু করে গলার সেটও বাদ যায়নি। বাসায় পড়ার টেবিল সাজানোর সবটুকু উপকরণ রয়েছে স্টলটিতে। সবই হাতে তৈরি করা হয়েছে। তাও আবার অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা তাদের স্কুলে তৈরি করেছে এসব পণ্য।
শিশুদের মস্তিষ্কে বিকাশের একটি প্রতিবন্ধকতার নাম অটিজম। আর যেসব শিশু এ রোগে আক্রান্ত তাদের অটিজমে আক্রান্ত শিশু বলা হয়। মানসিকভাবে অনেক পিছিয়ে থাকায় স্বাভাবিকভাবে তারা জীবন যাপন করতে পারে না। ফলে সমাজে তাদের ‘বোঝা’ মনে করা হয়। অটিজমে আক্রান্তরা যে সমাজের বোঝা নয়, তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্চা করা হলে যে তারাও হয়ে উঠতে পারে সৃজনশীল কর্মক্ষম মানুষ- তারই প্রমাণ যেন বই মেলায় পাওয়া গেলো। মেলায় আগত দর্শনার্থীর মনে এই বার্তাটি জুড়ে দিতে ‘নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন’র এমন স্টল।
পাঠক হৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার করেছে নগরীর অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদধ্বনিতে মুখর থাকে মেলার প্রাঙ্গণ। সে প্রাঙ্গণে সবার কাছে নিজেদের সক্ষমতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা। সমাজের প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে তাদের এ উদ্যোগ।
স্টলে থাকা নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ পূর্বদেশকে বলেন, মানুষ বই কিনতে বা দেখতে বইমেলায় আসে। তাদের পদচারণায় মুখর থাকে পুরো মেলাপ্রাঙ্গণ। সমাজের সকলস্তরের মানুষের আগমন ঘটে এ মেলায়। তাই তাদের সবাইকে জানান দিতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের এ স্টল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা যে সমাজের বোঝা নয়, তাদের সঠিকভাবে পরিচর্চা করলে তারাও যে হতে পারে স্বনির্ভর একজন মানুষ- এই বিষয়টিকে প্রমাণিত করতেই আমাদের এই প্রয়াস। এখানে আসা দর্শণার্থীদের মাঝে অটিজম সচেতনা বিষয়ক লিফলেট ও বই বিতরণ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বই হচ্ছে জ্ঞানের ভান্ডার, তাই মানুষ বই কিনে পড়ে। আর সেজন্যই বই মেলায় আসা হয় সবার। সে জ্ঞানের সাথে অটিজম শিশুদের সৃজনশীলতা আর সক্ষমতার কথা আমরা জানিয়ে দিতে চাই। যাতে আর কোনো অটিজমে আক্রান্ত শিশু সমাজে অবহেলায় পড়ে না থাকে।
কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে গুণ গুণ করে গাইছিল শুভনীল দাশ রিবু। অটিজমে আক্রান্ত শিশু হলেও দারুণ গায় সে। পূজোর আসরে এবং টেলিভিশনের পর্দায় গান গায় ছেলেটি। নিজেদের তৈরি পণ্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে স্টলে বসেছে রিবু। তার সাথে রয়েছে আরেক অটিজমে আক্রান্ত শিশু লতিফুর। সেও ব্যস্ত সময় পার করছে স্টলটিতে। লতিফুরের কাছ থেকে সে কি কি তৈরি করেছে জানতে চাইলে সে বলে, আমি পার্ল মুক্তা দিয়ে আপেল, আঙ্গুর, কলা ও শাড়ি বানিয়েছি।
স্টলের শিশুদের সাথে ছিলেন নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি ডা. বাসনা মুহুরী। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, স্টলে শিশুদের হাতের তৈরি ফুল, টিস্যু, হাতের ব্যান্ড, পাটের ব্যাগ, টি-শার্ট, ২০ ধরণের গলার সেট, নান্দনিক আয়না, ব্লকের শাড়ি, রং-তুলিতে আঁকা ছবি, ঝাড়বাতি বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে নয়, শুধু মানুষের কাছে তাদের সক্ষমতার কথা জানাতে এ স্টল। একটু বুঝলে, একটু প্রশিক্ষণ দিলে তারা দারুণ কিছু করতে পারে। তিনি আরও বলেন, ২০১০ সাল থেকে শুরু করি আমাদের অটিজম স্কুল। এ সময়ে মোট ১৭ জন শিশু স্বাভাবিক হয়ে সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করছে। এমনকি তাদের মধ্যে একজন এইচএসসিও পাস করেছে।
শিশু বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক নিষ্পাপ অটিজম শিশুদের স্কুল নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও জানান। তিনি বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন কেউ না কেউ জানতে আসে। তাদের বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলের। অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও শহরে রেখে পড়ানোর সুযোগ হয় না। তাই তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাসহ নিজস্ব ভবনে নিষ্পাপ অটিজম স্কুলটি স্থানান্তর করার চেষ্টা চলছে।