মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি

20

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় এখন আমাদের গায়ে আঁচড়ে পড়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যা এবং উত্তপ্ত সমুদ্রের বাঁধভাঙা জোয়ার আমাদেরকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাস্তবে গ্রিন হাউস অ্যাপেক্ট এর প্রভাব একেবারে ঘরেই চলে আসছে। ষড় ঋতুর বাংলাদেশের প্রকৃতির সব নিয়ম উলটপালট হয়ে পড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু কখনো অনাবৃষ্টি কখনো অতিবৃষ্টি সামগ্রিক আবহাওয়ার চিত্রকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। টানা কয়েক দিনের অতিবর্ষণ ও সমুদ্র-নদ নদীর জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের অবস্থা হয়েছে নাজুক। বৃষ্টি থামার দুদিনপরও পুরোপুরি পানি নামেনি। বান্দরবান, কক্সবাজারে পাহাড়ধসসহ পুরো চট্টগ্রামে জনজীবনের ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে ব্যাপক। দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত সংবাদসূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে ঐ সকল এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কে এক গলা সমান পানি উঠার ফলে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সাথে চট্টগ্রামের যান চলাচল বন্ধ থাকে তিনদিন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় বন্যার ¯্রােতে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৬ জন শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ পানিতে ভেসে যায়। পরে মৃত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়। গত শুক্রবার পর্যন্ত চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও বান্দরবানের ৮০ শতাংশ এলাকা ছিল ৫ থেকে-৮ ফুট পানির নিচে ছিল। টানা প্রায় ৬দিনের দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামের ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। সামুদ্রিক জোয়ারের ঢেউয়ে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় মারাত্মক ভাঙন দেখা দিয়েছে। গ্রাম ও নগরের জলাবদ্ধতার জন্য নদী, খাল, জলাশয় ও ড্রেনগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব কিংবা আরও অনেক অবকাঠামোগত সমস্যার কথা সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম মহানগরে রীতিমত দুই সংস্থার মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে। কিন্তু আমাদের জানা থাকা চাই, বন্যা ও জলাবদ্ধতা কেবল বাংলাদেশ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবহাওয়া আরও চরম ভাবাপন্ন ও তীব্র হয়ে উঠছে। চলতি বছরের গ্রীষ্মে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে প্রথমে রেকর্ড মাত্রায় উষ্ণতা দেখা গেছে। তাপপ্রবাহের পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টি, বন্যা ও ভূমিধসের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়ে চলছে। বর্তমানে ¯েøাভেনিয়া, অস্ট্রিয়া ও ক্রোয়েশিয়া চরম বৈরী আবহাওয়া মোকাবেলা করছে। ¯েøাভেনিয়ায় বিধ্বংসী বন্যার কারণে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পর হতে দেশটি এমন বিপর্যয় দেখে নি। এই দিকে গত মাসের মাঝামাঝিতে গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় ধরনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছিল, দুই সপ্তাহেরও অধিক সময়ের প্রচেষ্টার পর দাবানল নিয়ন্ত্রণে আসে। অন্যদিকে কানাডায় বর্তমানে সক্রিয় হাজারখানেক দাবানলের মধ্যে ছয় শতাধিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের বেশ কিছু অঞ্চলেও দাবানল বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্তুগাল ও অস্ট্রেলিয়ার পরিস্থিতিও প্রায় একই। গত কয়েকমাস আগে যুক্তরাজ্যে চরম খরা দেখা দিয়েছিল। কোন কোন জায়গায় ভুগর্ভস্থ পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানি সংকটে পড়েছিল দেশটি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ভূমির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে দাবানল আরও তীব্র হতে পারে। কারণ, সমগ্র বিশ্বেই চরম ও দীর্ঘস্থায়ী তাপ গাছপালা ও মাটি হতে অনেক অধিক আর্দ্রতা টেনে নিচ্ছে । আবহাওয়ার এই শুষ্ক অবস্থা কাজ করছে দাবানলের জ্বালানি হিসেবে। পৃথিবী যত উষ্ণ হবে, বায়ুমন্ডল তত অধিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারবে। এর ফলে খুব কম সময়ে ও ছোট এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেতে পারে। পাকিস্তানে গত বছরের জুলাই ও আগস্টে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের ফলে ৩ কোটিরও অধিক মানুষ বন্যার কবলে পড়েছিল। গত কয়েক দিনে প্রবল বন্যা দেখা দিয়াছে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের আশপাশে। সেইখানে ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় প্লাবিত হয়েছে বহু জায়গা, মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪৮ জনের। একই অবস্থা ভারেতেও। গত মাসে দেশটিতে অতি বৃষ্টির কারণে বেশ কয়েকটি রাজ্যে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। এসব বিষয় আলোচনা করলে ভাবতেই অবাক লাগে কী এক মহা বিপর্যয়ের মুখে আমরা দাঁড়িয়ে আছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখন প্রতি বছরই বাড়বে। বৃষ্টিপাতও বাড়বে, দেখা যাবে অনাবৃষ্টি ও বন্যা। এসব জলবায়ু পরিবর্তনের বড় হুশিয়ারি ! এরফলে পরিবর্তন ঘটতে পারে সমুদ্র¯্রােতের। ফলে মৌসুমি বায়ুতেও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণায়নে আমাদের খুব একটা ভূমিকা নেই বটে; কিন্তু বৈশ্বিক অবস্থান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন নয়, সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণায়নের অভিঘাত আমাদের উপরও নেমে আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে মানুষ অধিক শহরমুখী হতে পারে। ফলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সামগ্রিক চিত্র যথেষ্ট আতঙ্কের। এই সকল বিষয় মাথায় রেখে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা করা জরুরি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জলাবায়ু সন্মেলনে এসব বিষয় বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেও ফল পাচ্ছেন না। এখন আমাদের নিজের ঘর সামলাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা।