মন্ত্রীর কাছে হারানো চাকরি ভিক্ষা চাইলেন ভিক্ষুকেরা

19

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভিক্ষুকদের হাতে ভিক্ষার থালা নয়, আছে একটি কাগুজে দরখাস্ত। যেখানে হারানো চাকরি ফিরে পওয়ার আকুতিগুলো শব্দে রূপ নিয়েছে। পুরো দশবছর চাকরি করার পর বিনা নোটিশে সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের আমলে চাকরি যায় ৪০ ভিক্ষুকের। যাদের ভিক্ষুক জীবন থেকে নিয়ে এসে পরিচ্ছন্নকর্মীর চাকরি দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। সেই চাকরি ফিরে পেতে কখনো প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন, মেয়রের বাড়িতে ঘুরপাক, মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়ার সাথেও দেখা করেছেন তারা।
সাবেক প্রশাসকের সিদ্ধান্তে বর্তমান মেয়রও অনড়। বাকিদের আশ্বাসের কোনো গতি না দেখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর গাড়ি আটকালেন তারা। মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম মন দিয়ে তাদের কথা শুনেন। হাতে থাকা দরখাস্তটিও নিলেন। আশ্বাস দিলেন বিষয়টি তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে দেখবেন। গতকাল আন্দরকিল্লা পুরাতন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ভবনে একটি অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। চসিক কাউন্সিলরদের ‘সিটি কর্পোরেশন প্রশাসন অবহিতকরণ’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মন্ত্রী। অনুষ্ঠানে আসার খবরে সকাল থেকে সেখানেই অবস্থান নিয়ে মানববন্ধন করেন ভিক্ষুকরা। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী কামাল হোসেন জানান, পুরাতন নগর ভবন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মহোদয় বের হওয়ার সময় গাড়ির সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন দারোয়ান ও পুলিশ আমাদের টানাটানি করছিল। পরে দুই মিনিট কথা বলার অনুরোধ জানালে মন্ত্রী মহোদয় রাজি হন। স্যার আমাদের কি সমস্যা জানতে চান। পরে আমাদের সমস্যার কথা বলেছি। আমাদের চাকরি ফিরে পেতে স্যারের কাছে একটি আবেদনপত্রও দিয়েছি। স্যার আমাদের আবেদনটা গ্রহণ করেছেন ও বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর শুরু হলে নগরীকে ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নেয় চসিক। সেসময় মূল সড়কের ২৫০ জন ভিক্ষুককে ৪ হাজার ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। যাতে রাস্তায় ভিক্ষা না করে স্বাবলম্বী হতে পারেন তারা। এছাড়াও আরো ৪৬ জন ভিক্ষুককে নিয়োগ দেওয়া হয় নগরীর মোড়গুলো ভিক্ষুকমুক্ত রাখতে। প্রথমে তাদের সিটি করপোরেশনের চতুর্থশ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো। ৯ বছরে চার দফায় সে বেতন বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৭০০ টাকা। ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি এসব ভিক্ষুককে নিয়োগ দেন তৎকালীন বিএনপি সমর্থিত মেয়র এম মনজুর আলম। পরে বিশ্বকাপও শেষ হয়ে যায়, ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে চাকরি পাওয়া ভিক্ষুকরা নগরের মোড়ে মোড়ে ভিক্ষুকদের সরিয়ে দিতে গেলে বাধার সম্মুখীন হন। পরে পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাননি তারা।
এই সময়ের মধ্যে রদবদল হয় মেয়রের চেয়ারেও। দায়িত্বে আসেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি এসব ভিক্ষুককে পরিচ্ছন্নতা বিভাগে কাজ দেন। ডোর টু ডোর কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বর্জ্যরে কন্টেইনার পাহারা দেওয়া তাদের কাজ ছিল। যাতে কেউ বর্জ্য ফেলতে আসলে ডাস্টবিনের বাইরে না ফেলেন। পরে ডোর টু ডোর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ডাস্টবিনে আর কেউ বর্জ্য ফেলতে আসে না। ভিক্ষুক থেকে পরিচ্ছন্নকর্মীতে পরিণত হওয়া শ্রমিকরাও দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছিলেন না বলে অভিযোগ করা হয়। ঠিকমতো কাজ না করলেও বেতন হয়েছে নিয়মিত। চাকরিচ্যুত এসব পরিচ্ছন্ন কর্মী প্রশ্ন তুলেছেন- কাজ না করে বেতন পেলাম কিভাবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে দায়িত্বে থাকা এক ভিক্ষুক প্রতিনিধি জানান, সব পরিচ্ছন্ন কর্মীদের হাজিরা তৈরি করে পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। তাদের সেই হাজিরা অনুসারে বেতন তৈরি করে সচিবালয় বিভাগের সংস্থাপন শাখা। যদি নিয়মিত কাজ না করে, তাহলে পরিচ্ছন্নতা বিভাগ এত বছর হাজিরা দিয়ে আসছে কিভাবে?
জানা গেছে, চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৭৩০ জন, অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৮৯৮ জন। সবমিলিয়ে ১ হাজার ৬২৮ জন শ্রমিক ডোর টু ডোর কার্যক্রমে শ্রমিক নিয়োগের প‚র্ব থেকেই করপোরেশনে কাজ করতেন। ডোর টু ডোর শ্রমিকসহ মোট শ্রমিক সংখ্যা বর্তমানে ৩ হাজার ৬৪০ জন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চসিকে ২ হাজার শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন থাকলেও ওই প্রকল্পের অধীনে ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। চলতি বছরের আগস্ট মাসেই ৫৩ জন শ্রমিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
প্রসঙ্গত, সিটি করপোরেশনের পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষ হয় গত ৫ আগস্ট। খোরশেদ আলম সুজন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি করেন। সে কমিটি শ্রমিক নিয়োগে প্রশাসনিক অনুমোদিত পদের অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের আইনত কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে। এ ছাড়া অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত। কোনোভাবেই পরিচ্ছন্ন বিভাগ কর্তৃক যাতে আর শ্রমিক নিয়োগ করা না হয়- এ মর্মে একটি প্রশাসনিক আদেশ জারী করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তদন্ত কর্মকর্তা মুফিদুল আলম। সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত মোট শ্রমিকের অতিরিক্ত ৫৩ জন পরিচ্ছন্নকর্মী নেওয়া হয় বলে তথ্য উপস্থাপন করা হয়। তারই প্রেক্ষিতে নিয়োগের প্রথম মাস থেকে বেতন বন্ধ রাখা হয় সেসব শ্রমিকদের। গুঞ্জন ছিল তাদের চাকরিচ্যুত করার। ম‚লত তাদের চাকরি বাঁচাতেই ভিক্ষুকদের চাকরিচ্যুত করার প্রস্তাব তোলে পরিচ্ছন্ন বিভাগ- এমন অভিযোগও করেন এক সময়ের ভিক্ষুক যারা এখন চাকরি করে সংসার চালাচ্ছেন।