ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয় নয় সুষম বণ্টন চাই

35

একেকটি দূর্যোগ মানেই একেকটি সৃষ্টি। এ পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি ভাইরাসজনিত দূরারোগ মানবসমাজে বড় বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে, অসংখ্য মানুষ এর শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, আর বাঁচার লড়াইয়ে জেতার জন্য অনেকে তাদের মনন ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছে ভ্যাকসিন বা টিকা। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এবারের করোনা ভাইরাসটি এ শতকের সবচেয়ে আলোচিত ও ক্ষতিকর ভাইরাস। যার সংক্রমণে বিশ্বের প্রায় ১৯ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়। যদিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে কম সংক্রমণ ঘটেছে বাংলাদেশে, কিন্তু করোনা আতঙ্কে দিন কাটছে এদেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের। বিশ্বের সকল ভুক্তভোগীর মত বাংলাদেশের মানুষও আশা করে, করোনা প্রতিরোধে আবিস্কৃত ভ্যাকসিন তারাও সঠিক সময়ে পাবেন। এরমধ্যে ২০২০ সাল বিদায় লগ্নে ভ্যাকসিন আবিস্কার ও প্রয়োগের খবর আসে বিশ্ববাসীর কাছে। যুক্তরাজ্য প্রথম এ ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু করে, এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন প্রায় সবকটি উন্নত দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর প্রথম ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করেছে। নানা উদোগ সরকারের পদক্ষেপে আমরাও আশা করেছিলাম ভ্যাকসিন আমরাও সর্বগ্রের তালিকায় থাকবে, কিন্তু নানা জটিলতায় তা পেতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। সমস্যা এখানে নয়, যখন আমাদের প্রতিশ্রুত টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্তৃক তথ্যের বিভ্রাট ঘটে, তখন সংশয়, সন্দেহ ও শঙ্কার ডালপালা বিস্তার ঘটে। গত কয়েকদিন এ বিষয়টিই ছিল আমাদের প্রধান খবর, তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভ্যাক্সিমকো কর্তৃপক্ষ দ্রুত সেই সন্দেহ দূর করতে সক্ষম হয়েছে বলে আমরা মনে করি। গত রবিবার রাতে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যম খবর দেয়, ভারত সরকার নিজ দেশে টিকার চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর অর্থ বাংলাদেশ শিগগিরই এই টিকা পাবে না। এমন খবরে বাংলাদেশের টিকাপ্রত্যাশী মানুষের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। সোমবার দিনভর চলে ব্যাপক গুঞ্জন। তাহলে কী হবে? দিনের শেষভাগে জানা গেল খবরটি সঠিক নয়। ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, বাংলাদেশ সময়মতোই টিকা পাবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও বলেছে, আগের ঘোষিত সময়ে অর্থাৎ চলতি মাসের শেষ দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই টিকা আসবে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত এই টিকা ভারতে উৎপাদন করবে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। বেক্সিমকোর মাধ্যমে এই টিকার মোট তিন কোটি ডোজ আমদানির বিষয়ে একটি চুক্তিও হয়েছে। সম্প্রতি ভারত সরকার তাদের দেশে জরুরি ভিত্তিতে এই টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশও এই টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে টিকা আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে টিকার ভারতীয় উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউটও জানিয়েছে, টিকা রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন আনার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, সিএমএইচডি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্যাকসিনসংশ্লিষ্ট অন্য শাখাগুলোও প্রস্তুত আছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সোমবার বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। ভারতে উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশ প্রথম থেকেই পাবে। জানা গেছে, ভারত বাণিজ্যিক রপ্তানি বন্ধ রাখবে তবে বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তিটি তার আওতায় আসবে না। এদিকে টিকা কেনার জন্য সরকার আরো প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ফলে এই প্রকল্পের মোট খরচ দাঁড়াবে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
আমরা ধরেই নিতে পারি, বাংলাদেশ চলতি মাসেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন টিকা পাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসবে। সরকারের প্রটোকল মেনে বেসরকারি হাসপাতালগুলো টিকা আনতে পারবে এবং টিকা দিতে পারবে। বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারের প্রটোকল মেনে টিকাদান কার্যক্রম চালাতে পারবে। তবে এ মুহূর্তে যেহেতু পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একটাই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ফলে ভ্যাকসিনের সুষম বণ্টনের দিকে নজর রাখতে হবে। কারণ করোনার ভ্যাকসিন প্রস্তুত, এর কার্যকারিতা এবং সুষ্ঠু বণ্টনের ওপর নির্ভর করছে করোনার ভবিষ্যৎ। পুরো পৃথিবীর মানুষ একটি টিকার জন্য অধীর আগ্রহে আছে। শঙ্কাও আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, কারা টিকা পাবে তার একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৮ বছরের নিচের কাউকে টিকা দেয়া হবে না। এ ছাড়া গর্ভবতী মহিলা ও হাইরিস্কেরি রোগীদের টিকা দেয়া হবে না। এ হিসাবে ৪০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। যাই হোক আমাদের প্রত্যাশা মানবিক এ বিপর্যয়ে কোভিড-১৯ টিকা যেন সবাই পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।