ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে

12

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। যে দিনটিকে বিশ্বব্যাপী ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধুবান্ধব, স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ মানুষেরা এই দিনে একে অন্যকে তাদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানায়। বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও প্রতি বছর এ দিনটি ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনায় উদযাপন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এর স্বীকৃতি বা কোন আয়োজন না থাকলেও সরকারি বিধিনিষেধ না থাকায় এর জনপ্রিয়তা এখন আকাশছোঁয়া। দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য যাই হোক, দেশের তরুণ তরুণিরা এ দিনটিকে রঙ্গিনময় করে তোলে নানা আয়োজনে। তবে বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে, যারা নিজেদের দেশে ভালোবাসা দিবস পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে একসময় জন্ম দিনের উৎসব, ধর্মোৎসবের মতই দিবসটি পালন করা হত। কিন্তু মানবতার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে নিজেদের ভোগ ও আনন্দ উদযাপন মুখ্য হয়ে যাওয়ায় এবং দিবসটি পালন করতে গিয়ে গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপান করায় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এ দিবসটি পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এ দিবস উদযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অনেক মুসলিম দেশ রয়েছে যেখানে দিবসটি পালনে বিশেষ নিষেধ রয়েছে। আরব রাষ্ট্রসমূহ ছাড়াও পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে সে দেশের আদালত। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ হিসেবে কিছুটা সমীহ করে পালন করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটি শুরু হয় অত্যাচারী রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দিয়ে। তৃতীয় শতকে সম্রাট ক্লাডিয়াস খ্রিস্টধর্ম প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এমনকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্যুর ভয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম পালনে পিছপা হননি। কিন্তু যা হবার তাই হলো, সম্রাট ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখলেন। ভ্যালেন্টাইনের জীবনের শেষ সপ্তাহগুলোতে ঘটলো এক জাদুকরী ঘটনা। তিনি যে কারাগারে বন্দি ছিলেন সেখানকার কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হন। কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনকে জানান, তার মেয়ে জুলিয়া জন্মগতভাবেই অন্ধ, ভ্যালেন্টাইন তাকে একটু পড়ালেখা করাতে পারবেন কিনা। জুলিয়া চোখে দেখতে পেতেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী। ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে রোমের ইতিহাস পড়ে শোনাতেন, পাটিগণিত শেখাতেন। মুখে মুখে প্রকৃতির বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতেন ও ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেন। জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনের চোখে দেখতেন অদেখা পৃথিবী। তিনি ভ্যালেন্টাইনের জ্ঞানকে বিশ্বাস করতেন, ভ্যালেন্টাইনের শান্ত প্রতিমূর্তি ছিলো জুলিয়ার শক্তি। একদিন জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করেন- ভ্যালেন্টাইন, সত্যিই কি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন ? হ্যাঁ, তিনি সবই শোনেন। জানো, রোজ সকাল আর রাতে আমি কি প্রার্থনা করি? প্রার্থনা করি, যদি আমি দেখতে পেতাম। তোমার মুখ থেকে আমি যা যা দেখেছি তার সবই আমি দেখতে চাই ভ্যালেন্টাইন। আমরা যদি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি তাহলে তিনি আমাদের জন্য যা ভালো তার সবই করেন। ভ্যালেন্টাইন উত্তর দিলেন। এভাবে প্রার্থনা করতে করতে একদিন জুলিয়া ঠিকই তার দৃষ্টি ফিরে পেলেন। কিন্তু সময় ঘনিয়ে এসেছে ভ্যালেন্টাইনের। ক্ষুব্ধ ক্লাডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার দিন ধার্য করলেন। দিনটি ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ অব্দ। মৃত্যুর আগের দিন ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে লেখা ছিলো, ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন। ১৪ ফেব্রæয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু কার্যকর হয় ও তাকে বর্তমান রোমের প্রক্সিদেস গির্জার স্থলে সমাহিত করা হয়। কথিত রয়েছে, ভ্যালেন্টাইনের কবরের কাছে জুলিয়া একটি গোলাপি ফুলে ভরা আমন্ড গাছ লাগান। সেখান থেকে আমন্ড গাছ স্থায়ী প্রেম ও বন্ধুত্বের প্রতীক। এর প্রায় দু’শ বছর পর ৪৯৬ অব্দে পোপ প্রথম জেলাসিউস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সামগ্রিকভাবে দিনটি ছিল এক অন্ধ শিশুর প্রতি এক ধর্মপ্রাণ চিকিৎসকের মানবিক ভালোবাসা, স্রষ্টার মহাশক্তির পরিচয়কে তুলে ধরা। কিন্তু দিনটি ক্রমান্বয়ে বিকৃতভাবে পালন হচ্ছে। যাতে নেই কোন পবিত্রতা, মানবিকতা আর প্রকৃত ভালোবাসা। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে, দিনটি ফ্রি সেক্স ডে হিসেবে পালন হয়, যা জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। বাংলাদেশে দিনটি পালন করতে গিয়ে টিনেজ, তরুণ-তরুণি বা যুবক যুবতিদের অনেকে নৈতিকতা ও সামাজিক ব্যাভিচারে লিপ্ত হচ্ছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বরং ক্ষতির কারণ। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে ফুলের বাণিজ্য জমজমাট হয়ে উঠে। ফুল ব্যবসায়ীদের হিসেবে ভালোবাসা দিবস আর পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী প্রায় ২হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয় তাদের। এ দিন অন্যান্য ফুলের তুলনায় গোলাপ ফুলের চাহিদাও বেড়ে যায় অনেক বেশি। আমরা মনে করি, দিবসটির সঠিক ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরা সময়ের দাবি। নচেৎ ভ্রান্তির মধ্যে দিবসটি পালন করতে গিয়ে আমাদের প্রজন্ম পথভ্রষ্ট হচ্ছে। সমাজের সকলের উচিত নিজ নিজ পরিবারের মা, বাবা, ভাই-বোন এবং সমাজের অবহেলিত মানুষকে ভালবাসা। যে ভালবাসার মধ্য দিয়ে সকলের মাঝে সুখ ও শান্তি বিরাজ করে। যে ভালবাসার মধ্য দিয়ে নিজ পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে-এমনটি প্রত্যাশা।