বিজয়ের মাস শুরু

0
বিজয়ের  মাস শুরু

বাঙালির জাতীয় জীবনে আবারও এসেছে গৌরব ও প্রত্যয়দীপ্ত চেতনা এবং বহু আকাক্সিক্ষত ও অহঙ্কারের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ মাসেই বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আর নিজস্ব পতাকা পেয়েছিল। একাত্তরের এই দিনে বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিজয়গাঁথা রচিত হয়েছিল। হাজার বছরের স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি অগুনতি তাজা প্রাণ বিসর্জন আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত বিজয় অর্জন হওয়ায় ডিসেম্বর তাই বাঙালি জাতির কাছে যুগপৎভাবে বিজয়োল্লাস ও বেদনাবিধূর শোকগাঁথার মাসও। এবার বিজয়ের ৪৮ বছর পূর্তি হল।
অপরদিকে, বাংলার অভ্যন্তরে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য ও অহংকারের। দেশের যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা হয়েছে চট্টগ্রামে। বাঙালির মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পাঠ করা হয়েছে বীর প্রসবিনী চট্টগ্রাম থেকেই। তারই ধারাবাহিকতায় ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, বীর বাঙালির অহংকার’-তেজোদ্বীপ্ত স্লোগানকে ধারণ করে বিজয় মেলার প্রচলনও হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সিপাহ্সালার মাস্টারদা’ সূর্যসেনের স্মৃতিধন্য নগর চট্টগ্রাম থেকেই। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে এসে যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তারই ধারাবাহিকতায় নগরীর আউটার স্টেডিয়ামে এবারও বিজয় মেলার বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকছে পুরো মাসজুড়ে। পাশাপাশি বিজয়ের স্মারক ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই আজ দেশজুড়ে পালিত হবে মুক্তিযোদ্ধা দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-আর্থিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানবোধ জাগানোর লক্ষ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি পালিত হচ্ছে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর বাঙালির কাছে যেমন গৌরব ও আনন্দের উপলক্ষ নিয়ে বার বার ফিরে আসে, তেমনি সর্বস্ব হারানোর বেদনাবিধূর শোকগাঁথাও অনুরণন তোলে মনের গহীনে। বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিসহ সব অবলম্বন বিসর্জন দিয়ে বীর বাঙালি লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। অর্জন করেছে ভুখন্ডের মানচিত্র। লাল-সবুজের পতাকা। আত্মত্যাগ বাঙালির অস্থিমজ্জার অংশ হলেও স্বাধীনতা-সংগ্রামের মত এত বেশি ত্যাগ আর কখনও ঘটেনি। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে বিজয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পাক হানাদারদের নারকীয় তান্ডবের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছে বাংলার দামাল ছেলেরা। অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে ভাটি-বাংলার অবলা নারী। মুক্তিযোদ্ধাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে হারিয়েছে সম্ভ্রম-স্বামী-সন্তানকে। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর বিজয় লাভের মাত্র দু’দিন আগে চৌদ্দ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর ও আল শামসের সহযোগিতায় জাতির মেধা- মননের শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত পঙ্গু করে দেয়ার এধরনের নৃশংস ও ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞের নজির বিশ্বের কোথাও দ্বিতীয়টি নেই।
মূলতঃ ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে সালাম-রফিক-জব্বারসহ ভাষা শহীদরা। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে বহু আত্মত্যাগের ফসল হিসেবে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। সিপাহী বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ-এরূপ বহু বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের মনে স্বাধীনতার সত্তা জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তির নেশা ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠে বাঙালির জীবনে। বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় ও ত্যাগের অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। আর জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এক আলোকিত অধ্যায়। অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ে লাখো আত্মদানের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছে একটি লাল সূর্য। সবুজ জমিনের একটি পতাকা। একটি স্বাধীনতা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের স্বাধীনতাকামী আপামর ছাত্র-জনতা, সৈনিক, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীগণ নানাভাবে অংশ নিয়েছে। তেমনিভাবে এ দেশের কবিরা তাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা ও পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা বিরুদ্ধে কলমকে শাণিত রেখেছেন।