বাবুর্চি

120

ডাকসাইটে উকিল ত্রিদিব চক্রবর্তী আমাদের পাড়ায় থাকেন। পাড়ায় আন্য কোন উকিল না থাকায় তিনি উকিলবাবু নামেই পরিচিতি পান। তো সেদিন চেম্বারে বসে মক্কেলের সাথে মামলা নিয়ে আলাপ করছিলেন । এমন সময় বাইরে থেকে কে যেন হাঁক দেয়, অপু বাবুর্চি কি আছেন?
ডাকটা শোনে উকিল বাবুতো বটেই উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। খোঁজ নেয়ার কথা উকিল বাবুকে। তা না হোক ,অপু হলে না হয় ঠিক ছিল। কিন্তু অপু বাবুর্চি! অপু নামের বাবুর্চি থাকতেই পারে। তাই বলে এখানে কেন! সহকারীকে উকিল বাবু বলেন হাঁক পাড়া লোকটিকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য। লোকটি আসতেই উকিল বাবু পাওয়ারি চশমার ভেতর থেকে চোখ গোল গোল করে তাকালেন। তার চোখ জোড়ায় রাজ্যের বিষ্ময়। লোকটি ভেতরে ঢুকে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
কাঁচের আলমিরা,টেবিলের ওপর আইনের বই আর ফাইলপত্র দেখে বুঝে গেলেন,কোন বাবুর্চি নয় একজন উকিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কিন্তু তার যে বাবুর্চিকে দরকার। নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটি ঝটপট জানালো তিনি অপু বাবুর্চির খোঁজে এসেছেন। তার খুব তাড়া আছে একটু যেন অপু বাবুর্চিকে ডেকে দেয়া হয়।
উকিলবাবু এ কথা শোনে ক্ষেপে গেলেন,এটা উকিলবাড়ি। আমি হাইকোর্টের উকিল আপনি বাবুর্চি পেলেন কোথায়? অপু আমার ছোট ছেলে ও বাবুর্চি হতে যাবে কেন!
লোকটি একটু ভরকে গেলেন। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পেরে উকিল বাবুর সহকারি পরিস্থিতি সহজ করতে বললেন, আপনার ভুল হচ্ছে মশায়। অপু একটা ছোট ছেলে। স্যারের ছেলে। ও বাবুর্চি হতে যাবে কেন? আপনি বাইরে স্যারের সাইনবোর্ড দেখেননি?
লোকটি আমতা আমতা করে বললেন,জি দেখেছি । উকিল বাবুরটাতো গেইটের ডান পাশে আর বাম পাশে যে অপু বাবুর্চির নাম লেখা বোর্ড দেখলাম তাইতো……
লোকটির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উকিল বাবু বললেন, আপনার চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি মশায়? অ্যাডভোকেট ত্রিদিব ব্যানার্জি লেখা সাইনবোর্ড ছাড়া আপনি অপু বাবুর্চির সাইনবোর্ড পেলেন কোথায়?
বাম পাশের দেয়ালে যে দেখলাম। লোকটি শুকিয়ে যাওয়া গলায় ঢোক গিলতে গিলতে বললেন। লোকটির কথা শোনে ইতিমধ্যে কেউ কেউ তাকে পাগল কিসিমের লোক বলে ভাবতে শুরু করলেন। তবু কৌতুহল মেটাতে সকলে বাইরে ছুটে গেলেন। বাইরে এসে সবার চক্ষু চড়ক গাছ।
সত্যিইতো। একটা ঢালের উপর বড় বড় হরফে লেখা- অপু বাবুর্চি। পোলাও বিরিয়ানি, বাংলা, থাই, চাইনিজ, ইংলিশ এ পারদর্শি।
বাসার নিচ তলায় থাকেন উকিল বাবু। তার ছোট ছেলে অপু চক্রবর্তী ক্লাস ফোরে পড়ে। স্বভাবে সে একটু খেয়ালি ধরনের। তার স্বভাব আর কাজগুলি বেশ অদ্ভুত। তো অপুর নামের সাথে পদবীটা ওর পছন্দের নয়। অপু চক্রবর্তী। ক্লাসে গেলে দুষ্টু ছেলেগুলি ওকে চক্রবক্র বলে ডাকে। সে জন্য পদবিটাতে খারাপ লাগে বটে। তার ইচ্ছে পদবিতে একটা রাজসিক ভাব থাকবে। এর মধ্যে কত পদবির কথাইনা সে ভেবেছে। ব্যানার্জি, রায়,দত্ত, দাশ, চৌধুরী, খান, চাকলাদার, হাওলাদার, সৈয়দ আরো কতকিছুই না ভেবেছে। কিন্তু কোনটাই জুতসই মনে হচ্ছে না। তো সেদিন মার্কেটে যাওয়ার সময় একটি ঝুলন্ত সাইনবোর্ডের দিকে তার নজর পড়ে গেল। লেখা আছে- আবুল বাবুর্চি। বাবুর্চি নামটি তার কাছে একেবারে নতুন। সে জানেনা বাবুর্চির অর্থ কী? তবে তা ওর মনে ধরে। পরদিন মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে আরো একটি সাইনবোর্ড । মলয় বাবুর্চি। বাহ খাসা নামতো। তখনই সে ঠিক করে ফেলে এখন থেকে সে আর অপু চক্রবর্তী লিখবে না। লিখবে অপু বাবুর্চি।
সে যে নামের পরিবর্তন আনছে তা জানানো দরকার। কিন্তু মুখে তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কী করা যায়? বাবার সাইনবোর্ড দেখে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। বাবার মত নাম লিখে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিলে তো হয়। সবাই জেনে যাবে অপু নাম পরিবর্তন করেছে। যেই ভাবা নেই কাজ। একটা পিসবোর্ডের মধ্যে লিখে ফেলল- অপু বাবুর্চি। তখন মনে পড়ল আবুল বাবুর্চি আর মলয় বাবুর্চির নামের পর লেখা ছিল বাংলা ইংলিশ থাই চায়নিজে পারদর্শী। এ রকম কেন লেখা বুঝতে পারে না। কী মনে করে সেও লিখে দিল বাংলা,ইংলিশ থাই ও চায়নিজে পারদর্শী। যা হয় হোকগে। তারপর ঝুলিয়ে দিল বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে।
এদিকে এক লোক নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য বাবুর্চি খুঁজতে বেরিয়েছেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন বাবুর্চির কাছে লোকটি গেলেন কিন্তু লগ্ন পড়ায় তারা ব্যস্ত। লগ্ন মেনেইতো তার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। আর লগ্ন পড়লে বাবুর্চিদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কোন বাবুর্চি না পেয়ে লোকটি চরম হতাশ। এমন সময় এই জায়গায় এসে অপু বাবুর্চির সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখে তিনি আশায় বুক বাঁধেন।
এদিকে সকলে বাইরে এসে অপুর ঝুলানো বোর্ড দেখে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ে। লোকটি কিছুই বুঝতে পারে না। বোকা বনে যায়। জিজ্ঞেস করে, কী হলো? আপনারা ওভাবে হাসছেন কেন! উকিলবাবুর সহকারি হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশাই এ যে সে বাবুর্চি নয়, মস্ত বড় বাবুর্চি। মজুরি অনেক। আপনার সামর্থ্যে কুলাবে না। লোকটি বলে, না মশায় চিন্তা করবেন না। যত টাকায় নিক আমি দেব আমার মেয়ের বিয়ে। লগ্ন পড়াতে সব বাবুর্চিরা ব্যস্ত। দয়া করে অপু বাবুর্চিকে ডেকে দিন। এবার উকিল বাবুর সহকারি বলেন, আরে দাদা এ যে আমার স্যারের ছোট ছেলে অপু, যে ক্লাস ফোরের ছাত্র।
এদিকে সামনে হৈ চৈ শুনে ভেতর থেকে ছুটে এলো অপুর মা সাথে অপু। ওকে দেখে উকিল বাবু হেসে বললেন, এই যে দাদা আপনার অপু বাবুর্চি এসে গেছে। একে নিয়ে যান। আপনার মেয়ের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলুন। এই অপু যা ওনার মেয়ের বিয়ের রান্না করে দিয়ে আয়। তারপর আমাদের জন্যও রান্না করবি। অপুর মাকে বোর্ডের দিকে দেখিয়ে বলেন, দেখ তোমার ছেলে বাবুর্চি হয়ে গেছে। সবাই এক সাথে বলে, যাও অপু। আমরাও যাব তোমার রান্না খেতে। দেখতে হবে না তুমি কত মজার রান্না করতে পার।
অপুর মা বোর্ডের দিকে তাকালেন। অপু কিছু বুঝতে পারছে না দেখে মা এগিয়ে এসে বলেন, এটা কে লিখেছে?
অপু আবদারের সুরে বললো, মা আমি আর চক্রবর্তী লাগাব না। বাবুর্চি খুব খাসা নাম। আমি এখন থেকে বাবুর্চি লিখব। উকিল বাবু বললেন তা লিখতে পারিস যা ইচ্ছে। ওই যে লিখেছিস ইংলিশ, থাই ,চায়নিজে পারদর্শি লিখলি তা তুই কি ওগুলো রান্না করতে পারিস? অপু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালে, মা বললেন,আরে বোকারাম বাবুর্চি কারা জানিস? অপু মাথা নাড়ে, না। তখন মা বলেন,বিয়ে বাড়িতে যারা রান্না করে তাদেরকে বাবুর্চি বলে। এই যে ইংলিশ থাই চায়নিজ লিখেছিস সেগুলো ওই দেশের খাবারেরর কথা বলেছে।
অপু নিজের ভুল বুঝতে পারে। লজ্জা পেয়ে যায়।
এক দৌঁড়ে সে ভেতর ঘরে চলে যায়। এদিকে এ খবর পাড়ার দুষ্টু ছেলে হয়ে স্কুলে পৌঁছে যায়। দুষ্টু ছেলেগুলি বাবুর্চি বাবুর্চি বলে মজাতো করেই। আবার ম্যাডাম আপুরা অপুকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, অপু বাবুর্চি কেমন আছ। আর অপু তখন লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়।