প্রাথমিক শিক্ষায় এবার নতুন সংযোজন বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন লিটন দাশগুপ্ত

299

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখন শেখানো কার্যক্রম আধুনিকায়নে ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন অনেক কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করা হচ্ছে। এই রকম একটি সংযোজিত নতুন প্রক্রিয়া হচ্ছে বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশ্ন প্রণনয়। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গত ২৮ আগস্ট ২০১৯ সালে প্রদত্ত পরিপত্র অনুযায়ী দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা থেকে কার্যকর করার কথা ছিল। তবে সময় স্বল্পতার কারণে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা থেকে শুরু না হলেও গত বার্ষিক পরীক্ষা থেকে দেশব্যাপী নতুন নিয়মে বিদ্যালয় ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কাজ শুরু হয়। এই দিকে শুরুতেই বিদ্যালয় ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে বিভক্ত বা দ্বিমত সৃষ্টি হয়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধির জন্যে বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে অপেক্ষায় ছিলাম।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র আগে সমিতির মাধ্যমে প্রণয়ন করা হত। এক সরকারি নির্দেশনায় গত ’১৬ সাল থেকে উপজেলা কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী এই প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকেন উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, সদস্যসচিবের দায়িত্বে থাকেন সিনিয়র সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সদস্যমন্ডলীর মধ্যে কর্মরত অন্য সকল সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হওয়া শিক্ষকগণ ও শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
সত্যি কথা হচ্ছে সঠিক ভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কাজটি একেবারে সহজ কোন বিষয় নয়। তাই প্রত্যেক বিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সক্ষমতা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকের ধারণা ছিল; প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী শিক্ষক কর্তৃক প্রশ্ন ফাঁস হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ অধিকতর পরিশ্রম চিন্তা ও সময় ব্যয় না করে নোট কিংবা গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন প্রদান করবে, বিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ের জন্যে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ অভিজ্ঞ প্রশ্ন প্রণয়নকারী শিক্ষকের অভাব রয়েছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেটর যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়নে দক্ষতা নাও থাকতে পারে ইত্যাদি নানা রকম সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা উঠে আসে। তাই শুরুতেই অনেকের ধারণা ছিল ঋণাত্বক।
উল্লেখ্য বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষাসমূহে প্রশ্নপত্রের কলেবর পূর্বের তুলনায় বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনকার ৩য় শ্রেণি হতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কচিকাঁচা শিশু শিক্ষার্থীর ৬টি বিষয়ের প্রশ্নের কাগজের আকার আয়তন দেখলে, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মনে করে ভুল হতে পারে। এখানে দেখা যায়, তিন চার পৃষ্ঠা কাগজে যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল প্রশ্ন, গতানুগতিক বিভিন্ন প্রশ্ন, শূণ্যস্থান, মিলকরণ, সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, বর্ণনামূলক প্রশ্ন ছাড়াও আবার বাংলা ইংরেজীতে রয়েছে সিন-আনসিন প্রশ্নের ভরপুর। এছাড়া বাক্যের দৈর্ঘ্য ও শব্দ বিবেচনায় নিলে বা তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রে প্রশ্নের তুলনায় উত্তর মাপ অনেক ছোট। অর্থাৎ প্রশ্ন কয়েক বাক্যের আর উত্তর কয়েকটি শব্দ সমষ্টিতেই শেষ। এখানে এত সব বলা মানে সমালোচনা নয়, উল্লেখ করার মূল কারণ হচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কাজটি সহজ বিষয় নয় তা বুঝানোর জন্যে। তা সত্ত্বেও দেশে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সফলতার সাথে এই কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে বলে আমার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে বা অনুধাবন করতে পেরেছি। এখানে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধতা ও ত্রূটি বিচ্যুতি থাকতে পারে, এটি স্থানীয় বিচ্যুতি যা জাতীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঋণাত্বক প্রভাব নয় বা সমস্যা সম্ভাবনার কথা প্রমাণিত হওয়া নয়। হয়ত প্রথমবারের মত কয়েকটি বিদ্যালয়ে ক্রটি বিচ্যুতি ছিল, পরবর্তীতে তা খাটিয়ে উঠার সক্ষমতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রয়েছে বলে অনেকের মত আমারও বিশ্বাস।
প্রাথমিক বিদ্যালয় বিকেন্দ্রিকরণ সরকারের সদিচ্ছাকে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে এবং সমর্থন জানাতে হবে। একই ভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্টদের খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে বা অভিযোজিত হবার ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হবে। কারণ দীর্ঘ দিন প্রচলিত নিয়ম বা পদ্ধতি হঠাৎ পরিবর্তনে প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একই সাথে মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়নে অনেকের নিজ স্বার্থে আঘাত হেনেছে। তারা কোন ক্রমেই প্রশ্ন প্রণয়ন সফল হোক এটা চায় না, পরোক্ষভাবে বিরোধীতা করে যাচ্ছে।
এই দিকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র উন্নয়নে আর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে কিছু পরামর্শের কথা না বললে নয়। এই ব্যাপারে কিছু উন্নয়নমূলক পরামর্শ হচ্ছে প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাদে) উপজেলাভিত্তিক করার চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা বিদ্যালয় ভিত্তিক ও বার্ষিক পরীক্ষা উপজেলা কেন্দ্রিক হলে দুয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকার পাশাপাশি ফাইন্যাল পরীক্ষা হিসাবে আরো গ্রহণযোগ্যতা নিরপেক্ষতা ও মাননিয়ন্ত্রণে থাকবে। যদিও বিদ্যালয় ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে তা রয়েছে; এখানে বুঝাতে চেয়েছি, চুড়ান্ত পরীক্ষাকে উপজেলা কেন্দ্রিক করা হলে উৎসব মুখর ও একই পরিমাপে পুরো উপজেলার শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা যাবে, যে ভাবে পাবলিক পরীক্ষা সমূহ দেশব্যাপী একই প্রশ্নের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
এছাড়া বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ব্যয় সাপেক্ষ। তাই ফিসের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ উপজেলাভিত্তিক প্রতি শ্রেণিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর প্রশ্ন ছাপা আর বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতি শ্রেণিতে ২০/২৫ জন ছাত্রছাত্রীর প্রশ্নছাপা খরচ একই নয়। এই বিষয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রাপ্ত ফিসের তুলনায় পরীক্ষা সম্পর্কিত ব্যয় তুলনামূলক ভাবে বেশী। তাই বিদ্যালয় পর্যায়ে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে করে প্রশ্ন প্রণয়তা বা স্কুল কর্তৃপক্ষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই সরকার বা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বিবেচনায় এনে দ্রæত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক