পাহাড় নিধন ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ হোক

23

সম্প্রতি তিন দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে সংঘটিত তিনটি মৃত্যুর ঘটনা নগরবাসীর মনে প্রচন্ড দাগ লেগেছে। বিশেষ করে গত শনিবার ষোলশহর এলাকায় পাহাড়ধসে বাপ-মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা, রবিবার আগ্রাবাদে জলাবদ্ধ নালায় পড়ে দেড় বছর বয়সি সন্তানের মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। গত দুই বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নালায় পড়ে তলিয়ে গেছে ৭জন। একইসাথে নগরীর পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে গড়ে উঠা বসতবাড়ি পাহাড়ের মাটি ধসে ছাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। এ মাসের শুরুতে পাহাড়তলী আকবর শাহ এলাকায় পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনার মূল কারণ পাহাড় নিধন। ভূমিখেকো দুর্বৃত্তরা অবৈধভাবে সরকারি পাহাড় দখল করে মাটি কেটে সেখানে অবৈধ বাসাবাড়ি তৈরী করে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেন। অসহায় মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে এসব অবৈধ বাসায় ঠাই নিলেও একসময় তাদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ যন্ত্রনার। তাদের অনেককে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে যেতে হয়। সামান্য অর্থের লোভে যে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে এসব অসহায়দের টেলে দেয়া হয়-তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না। যারা এসব দুর্বৃত্তায়নের সাথে জড়িত তাদের বিচারও হয় না। এ বিচার না হওয়ার প্রবনতায় মূলত সরকারি ভূমি দখল মুক্ত করা যাচ্ছেনা। অবৈধ স্থাপনাও সরানো যাচ্ছে না। এতে ভূমি ধসে মানুষ ক্ষয়ের মত ঘটনাও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চার্যেও বিষয় অবৈধভাবে নির্মিত এসব স্থাপনায় সরকারি পরিষেবা পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসলাইন কীভাবে দেয়া হয, সেটিও চিন্তার বিষয়। অতীতে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসন থেকে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করা হয়, পাহাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা সরানো হবে, বিদ্যুৎ, গ্রাস ও পানির লাইন বন্ধ করা হবে। প্রশাসন ঢাকঢোল বাজিয়ে কামান নিয়ে পাহাড় উদ্ধার করতে গিয়ে বিফলে ফিরে আসেন। ফলে এ পাহাড়ে আর বন্ধ হয়না মৃত্যুর মিছিল। আমরা আশ্চর্য হই, জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনর দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে যেখানে জঙ্গল সলিমপুরের মত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় দখলমুক্ত হয়, সেখানে নগরীর পাহাড়গুলো কেন অবৈধ দখলমুক্ত হয় না, পাহাড় নিধন কেন বন্ধ হয় না? ‘ডাল মে কুছ কালি হ্যায়!’ এ কালি সরাতে না পারলে বিপর্যয়ও বন্ধ করা যাবে না।
সম্প্রতি ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া পাহাড় ধসের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আইডব্লিউ কলোনিতে অন্তত ৫০ ফুট উঁচু পাহাড়ের নিচে কাঁচা ঘর বানিয়ে নিম্ন-আয়ের লোকজন বসবাস করতেন। সকালে অতিবৃষ্টিতে পাহাড় থেকে মাটি ধসে নিচে ঘরের ওপর পড়ে। তাতে একই পরিবারের চারজন চাপা পড়লে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, খালেক নামে রেলওয়ের এক কর্মচারী এই পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করেন। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে ওই ব্যক্তি নাকি তাদের পুলিশের ভয় দেখাতেন। অনেক সময় পুলিশ নিয়েও আসতেন। এ কারণে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতো না। খাড়া পাহাড়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করায় সেখানকার মাটি নরম হয়ে যায়। ফলে অতিবৃষ্টিতে দেওয়ালসহ ধসে পড়ে পাহাড়ের মাটি। প্রশ্ন হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে পাহাড় কাটা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করা হয় কীভাবে? অভৈভাবে পাহাড় কাটা, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মতো কার্যক্রমে মূলত প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকে। ফলে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি ও উদ্যোগের প্রতিফলন দেখা যায় না। উলটো প্রশাসনের কারও কারও প্রশ্রয়েই এসব কাজ অবাধে সাধিত হয়, যা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা দরকার।
অনেক জায়গায় দেখা যায়, জনস্বার্থে কিছুটা পাহাড়কাটা জরুরি, তাও পরিকল্পিতভাবে হওয়া বাঞ্চনীয়। কিন্তু চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট লিংরোডের অবস্থা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এসব অপরিকল্পিত পাহাড় খনন নগরবাসীর জন্য কতবড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীও ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা যায়। স্থানীয়দের মতে, বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলে হয়তো প্রশাসনের টনক নড়বে না। বিষয়টি উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগও প্রয়োজন, যা না থাকায় প্রতিনিয়ত পাহাড় ধস ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসন কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) যদি এ ধরনের কার্যক্রম রোধে আন্তরিক হয়, তবে এ সমস্যার দ্রæত নিরসন হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পাহাড় ধস ঠেকাতে হলে, আগে পাহাড় রক্ষা করতে হবে-সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বোধশক্তি জাগ্রত হোক-এমনটি প্রত্যাশা সকলের।