পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে চাই কার্যকর উদ্যোগ

13

 

প্রতি বছরই বর্ষায় চট্টগ্রাম মহানগরীর কোনো না কোনো পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণহানিও হয়। গত এক যুগের অধিক সময়ে পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণ গেছে ২৫০ জনের। তবুও পাহাড়ে বসতি ঠেকানো যাচ্ছে না। বন্দরনগরীজুড়ে রয়েছে ২৮টি পাহাড়। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে। পাহাড় থেকে এসব ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি সরাতে কয়েক বছর নিয়মিত এবং কঠোর অভিযান চালিয়েও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। এবারও বর্ষার আগমনি ধ্বনিতে আবারও নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কোমরবেঁধে নামার ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সর্বশেষ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে পাহাড় এবং সাধারণ মানুষকে বাঁচানো যায় কিনা দেখার বিষয়। তবে এ জন্য অপেক্ষ করতে হবে প্রশাসনের অভিযান শুরু হওয়া পর্যন্ত। মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশসহ সহযোগী সকল সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অতীতের মত এবারও ১৮ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে ১৯টি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ৩১ মে সোমাবার উচ্ছেদ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে দপ্তরগুলোতে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট নগরসেবা কর্তৃপক্ষ ও সহযোগী সংস্থাগুলোতে চিঠি দিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে সহযোগিতা চাওয়া হয়। সূত্র জানায়, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং উচ্ছেদ তদারকিতে গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের মনিটরিং টিম। একইসাথে দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মো. নাজমুল আহসানের উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাহাড়ধসে যাতে কোনো মানুষের ক্ষতি না হয়, পাহাড় কাটা যেন বন্ধ হয় সেই ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। শুধু নগরীতে নয়, উপজেলাগুলোতেও পাহাড় নিয়ে সমস্যা আছে। ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি থাকা ১৮টি পাহাড়ের মধ্যে কিছু পাহাড়ে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা আছে। যে কারণে আইনগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাহাড়ের উচ্ছেদ কার্যক্রম তদারকিতে একটি সাব কমিটিও করা হয়েছে। উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোকে ঘিরে একটি ডকুমেন্টারি বানানো হবে। যেটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠিয়ে দিক নির্দেশনা চাওয়া হবে।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সর্বশেষ ২০০৭ সালে ভয়াবহতম পাহাড়ধসের ঘটনার পর ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি পাহাড়কে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ১৮টি পাহাড়ে মানুষের বসতি থাকায় এগুলোকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়। সে পাহাড়গুলোতে বর্ষা মৌসুম আসলেই উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। সচেতন করা ও অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আমরা লক্ষ করে আসছি, অতীতে এপ্রিল-মে মাসে জেলা প্রশাসন পাহাড়ে বসবাসরত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়ে বারবার বাধার সম্মুখিন হয়েছে। কথিত দখলদার ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের তদবিরে বা আন্দোলনের ফলে প্রশাসনকে উচ্ছেদ অভিযানে রণভঙ্গ দিতে হয়েছে। সঙ্গত কারণে অভিজ্ঞমহলের ধারণা উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী নগরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতাদের সাথে রাখতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসনিক কর্মতৎপরতার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে কমিটমেন্ট থাকতে হবে। কথিত আছে যে, ভোটের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছেন রাজনীতিবিলাসী নেতারা, যা অমানবিক এবং প্রশাসনের প্রতি অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ বটে। আমরা আশঙ্কা করছি, সামনে ধেয়ে আসছে বর্ষা। এর আগেই দ্রুত এসব বসতি সরানো না গেলে এই বর্ষায় ভারি বর্ষণের কারণে আবারো পাহাড়ধসে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। বড় দুঃখের সাথে বলতে হয়, পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু ঘটলে নীতিমালা প্রস্তুত হয়, তার তদন্তের জন্য কমিটি হয়, তদন্ত কমিটি সুপারিশ পেশ করে, কিন্তু তা কার্যত আর বাস্তবায়ন হয় না। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। কিন্তু গত ১২ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ সুনির্দিষ্ট নীতিমালার বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছায় পাহাড়ধসে হতাহত কমিয়ে আনা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়টিও প্রথম থেকেই উঠে এসেছে। এরপরও স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, ছিন্নমূল মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছেন। অতীতে সিটি কর্পোরেশন এসব ছিন্নমূলদের পুনর্বাসনের জন্য বাটালি হিলে নামেমাত্র টাকা নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে। তবে, সেই ভবনে এখন চসিকের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে তাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি পাহাড় কাটা ও পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনার পেছনে যে বা যারা থাকুক না কেন, প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নচেৎ উচ্ছেদ অভিযান সফল হবে বলে আশা করা যায় না।