পানি নিষ্কাশনের প্রতিবন্ধকতা দূর করুন

27

গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে রবিবার দিনভর টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরী ও এর আশেপাশের বহু উপজেলার নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এ সময় নগরীর পাহাড়গুলোতে ভূমিধসের ঘটনাও ঘটেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অতিবৃষ্টি জোয়ারের পানি বাড়তে থাকলে পুরো নগরীতে জলাবদ্ধতা তৈরী ও ভূমিধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইসাথে আশেপাশের উপজেলাগুলোতে বন্যারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত শনিবার টাইগারপাস এলাকায় পাহাড়ধসে পড়লে একটি চলন্ত মাইক্রোবাস সড়কে আটকে যায়। পরে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা মাটি সরিয়ে সেটিকে উদ্ধার করে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ফায়ার সার্ভিস ও চসিকের কর্মীদের তৎপরতায় রাস্তা পরিষ্কারের পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এদিকে চারদিনের টানা বর্ষণে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ঢল ও ড্রেনের পানি সড়কে উঠে আসে। ড্রেন ও নালার ময়লাযুক্ত পানি নিচু এলাকার বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়ে। চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বাজার রেয়াজুদ্দিন বাজার পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এতে পানিবন্দি মানুষ, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন অনেকে। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে চসিক মেয়রের বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সংবাদে। বহদ্দারহাটস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরীর নিজ বাড়ি মেয়র ভবনের নিচতলা ও গলিসহ আশেপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক ছবিতে দেখা গেছে গত শনিবার মেয়র সকালে স্বাভাবিকভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে সিটি কর্পোরেশনের একটি অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফেরার পথে তিনি নিজের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে আর ঢুকতে পারেন নি, রিকশা ও পায়ে হেঁটে এক হাঁটু পানি মাড়িয়ে বাড়িতে ওঠেন। এসময় মেয়র চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নিয়ে পুনরায় তাঁর ক্ষোভ ঝাড়েন। পরে চসিকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নগরীর বিভিন্ন এলাকার পানি দ্রুত অপসারণের নির্দেশ দেন ।
ভারি ও টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার এই চিত্র শুধু যে চট্টগ্রাম নগরীতে নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেমের নিম্নাঞ্চলেও সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা বা বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হতে আমরা দেখি। অবশ্য বেশকিছু এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে যায়; কিন্তু এর আগ পর্যন্ত যে ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে, তা দুঃখজনক। ভেবে দেখা দরকার, যদি ২৪ ঘণ্টা কিংবা ৪৮ ঘণ্টা টানা বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শহরের ভেতরের খালগুলো অবৈধ দখল, পানিপ্রবাহ ঠিক না থাকা এবং পানি শোষণের জন্য উন্মুক্ত জায়গা বা জলাশয়ের অভাব অনাকাক্সিক্ষত এ জলাবদ্ধতার কারণ বলে জানিয়ে আসছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। চট্টগ্রামের ব্যাপারে আমরা জানি, জলাবদ্ধতা দূর করতে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০১৮ সালে চসিককেও বাড়ৈপারা খাল সংস্কারসহ নালা ও খাল পরিষ্কারের জন্য ন্যূনতম বরাদ্দ দেয়া হয়। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, খাল ও নালায় পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব কিন্তু সিটি করপোরেশনের। কিন্তু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের ধিরগতি এবং অব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্পের কাজ বারবার সময় বর্ধিতকরণ ইত্যাদির কারণে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। সিটি কর্পোরেশনের কাজের গতি ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে তারা যতই নালা-নর্দমা পরিষ্কার করুক চাকতাই ও রাজাখালী খালসহ কর্ণফুলীতে পানি প্রবেশ মুখে যদি প্রতিবন্ধকতা থাকে তাতে বৃষ্টির পানি যাবে কোথায়? একই সাথে জোয়ারের পানি আটকানোর জন্য সবকটি ¯øুইচ গেট এখনও সচল করা হয় নি, ফলে বর্ষার আগে বড় ধরণের জলাবদ্ধতার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা বাস্তবে দৃশ্যমান হয়েছে মৌসুমের শেষ বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে। চট্টগ্রামের দুঃখ জলাবদ্ধতার এ সংকট কখন কাটবে এবং নগরবাসী কখন ভোগান্তি মুক্ত হবে-তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে না।
এতকিছুর পরও বলতে দ্বিধা নেই, জলাবদ্ধতার দায় শুধু নগরীর উন্নয়ন ও সেবা কর্তৃপক্ষগুলোকে দিয়ে দায় সারার কোন যুক্তি নেই। নগরবাসীরও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে নালা-নর্দমার স্বাভাবিক প্রবাহ যেন ব্যাহত না হয়, নগরবাসীকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এজন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন রয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়; ময়লাগুলো যেন সেখানে ফেলা হয় সেই ব্যাপারে নাগরিকদের দায়িত্বশীল হতে হবে।
চট্টগ্রাম ভৌগোলিক অবস্থান অতি প্রাকৃতিক। এখানে সমতল ভূমির চারদিকে রয়েছে পাহাড়, নদী, খাল ও সমুদ্র। অপরিকল্পিত নগরায়ন এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন আর অবশিষ্ট নেই। ৫৬টি খালের মধ্যে ২১টির অস্তিত্ব আছে মাত্র। ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে কেটে ফেলছে পাহাড়্, সেই সাথে বৃক্ষরাজিও সাবাড়। এতে পাহাড়ি ঢলের সাথে পলিমাটি নদী ও নালা-নর্দমায় পরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সব। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন। এর বাইরে প্লাস্টিক বর্জ্যতো আছেই। চউক যে কয়টি খাল উদ্ধার ও সংস্কার করেছে এর বাইরে আরো যেসব খাল বেদখলে আছে তা দ্রুত উদ্ধার করে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা জরুরি। একই সাথে পাহাড় নিধন বন্ধে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। আমরা আশা করি, চসিক, চউক ও জেলা প্রশাসন এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।