নীরবে পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

50

দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দরপতনের মধ্যে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে দামি কিছু শেয়ারের দাম বেড়েছে। দামি ও বাজার মূলধনে বড় অবদান রাখা কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় সূচকের গড় পতন খুব একটা বড় মনে হয়নি। কিন্তু কম দামের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এতে অনেকটা নীরবে পুঁজি হারিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
কিছু কিছু বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০১০ সালের থেকেও ভয়াবহ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে ২০১০ সালে যে মহাধস নামে তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। সে সময় একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতনের সঙ্গে সূচকের বড় পতন হয়েছিল। এতে নিঃস্ব হন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। সাম্প্রতিক সময়েও তালিকাভুক্ত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমেছে। এতে একটু একটু করে পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ সংখ্যাও কম নয়, লাখের অধিক। কিন্তু সূচকের বড় পতন হয়নি।
ফারুক হাসান নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, সবাই ২০১০ সালের ধসকে মহাধস বলেন। কিন্তু এখন যে নীরব ধস চলছে তা মনে হচ্ছে কেউ দেখছেন না। গত দুই মাসে আমার পুঁজি অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০১০ সালের থেকে এটা কোনো অংশেই কম নয়। শুধু আমার নয়, অল্প অল্প করে বাজারের সিংহভাগ বিনিয়োগকারীর পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। ভোটের পর প্রায় এক মাস ঊর্ধ্বমুখী ছিল বাজার। সে সময় তালিভুক্ত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ে। ফলে এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ৭০০ পয়েন্টেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করে বাজারের ছন্দপতন ঘটে। অনেকটা টানা দরপতন দেখা দেয়। এতে ডিএসইর প্রধান সূচক কমে প্রায় সাড়ে ৪০০ পয়েন্ট।
তবে সূচকের পতন যতটা হয়েছে বাজারের ক্ষতি এর চেয়েও বহুগুণ বেশি। কারণ দরপতনের সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে দেখা দিয়েছে চরম তারল্য সংকট। ফলে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া ডিএসইর গড় লেনদেন নেমে এসেছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। তালিকাভুক্ত ৩৫২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০০টিরই দাম কমেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশের ওপরে দাম কমেছে ১৯০টি প্রতিষ্ঠানের। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে।
সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতনের মধ্যে ৪৮টির শেয়ারের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে ২৪টির। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, রেকিট বেনকিজার, বার্জার পেইন্টস, মুন্নুজুট স্টাফলার্স, ইষ্টার্ণ লুব্রিকেন্ট, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, মেরিকো ও গ্রামীণফোনের মতো দামি ও বড় বাজার মূলধনের প্রতিষ্ঠান।
এদিকে পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হারকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজার ও ব্যাংকের সব থেকে বড় সমস্যা সঞ্চয়পত্র। সুদের হার বেশি হওয়ায় পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। ফলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার থেকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অনেক বেশি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। অথচ গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই নিট ৩০ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়ে গেছে। জানুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৮ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। একই সময় পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় যেখানে সরকারের ঋণ রয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রের তুলনায় অনেক কম সুদে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার সুযোগ থাকলেও অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির ফলে তা পারছে না। শেয়ারের নীরব দরপতনে বিনিয়োগকারী ও ব্রোকারেজ হাউজ মালিকদের আতঙ্কের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে স¤প্রতি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ডিএসই। এতে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের পাশাপাশি প্লেসমেন্ট বাণিজ্য অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসে। অবশ্য ডিএসইর ওই বৈঠকের আগেই ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য প্লেসমেন্ট বাণিজ্যকে দায়ী করেন।
এদিকে, নীরবে পুঁজি হারানোর কারণে বিনিয়োগকারী ও ব্রোকারেজ হাউজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন বলেন, বাজারে উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু অস্থিতিশীল হয়নি। আমরা সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল পর্যায়ে এনেছি।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে বাজারে উত্থান-পতন হতে পারে। তারল্য সংকট কিছুটা থাকতে পারে। তবে এ মুহূর্তে বাজার পতনের পেছনে উল্লেখ করার মতো কোনো ঘটনা নেই। অনেক সময় কারণ ছাড়াও বাজারে অনেক কিছু হয়ে থাকে। কমিশনের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহযোগিতা দরকার, আমরা দিয়ে যাচ্ছি। এর আগে, দেশের পুঁজিবাজারে ভয়বহ ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে। সেই সময়ও ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে ওই মহাধসের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা হয়। ফলে বর্তমনে সরকার খুবই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কথায়ও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আয়োজিত বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা কনফারেন্সে বিনিয়োগকারীদের তার ও সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখার আহব্বান জানান। তিনি বলেন, বাজারের ইনডেক্স (সূচক) কত হবে তা আমি বলব না। ইনডেক্স ঠিক করে দেবে অর্থনীতি। অর্থনীতি যত বড় হবে, পুঁজিবাজারের সূচকও ততটা বাড়বে।
ওই সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজারকে পেছনে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, ঠকবেন না। আমরা সবাই লাভবান হব। আমরা নিজেরা বিজয়ী হব, সরকারকে বিজয়ী করব।
বাজারের চলমান মন্দার কারণ হিসেবে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এখানে সিন্ডিকেট বিনিয়োগ চলছে। কৃত্রিমভাবে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়ানো হয়েছে। যে কোম্পানির শেয়ারের দাম আগে কখনও ২০ টাকা হয়নি, এমন শেয়ারের দাম ৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম এমন বাড়লে বাজারে বড় পতন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর পেছনে কারা রয়েছে তা সবাই জানে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাও জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বিএসইসি মাঝেমধ্যে লোক দেখানো জরিমানা করে। এভাবে কারসাজি বন্ধ করা যায় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন ভূমিকার কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে।