দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙুক

17


অতি বৃষ্টি, জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল, শহর-গ্রাম একাকার হয়ে পড়েছিল। মাত্র দু সপ্তাহ আগে নগর ও নগরীর বাইরে চট্টগ্রাম দক্ষিণের উপজেলাসহ পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও কক্সবাজারের অবস্থা নাজুক হয়ে উঠেছিল। যার রেশ এখনও শুকায়নি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যার কারণে গত ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চট্টগ্রামে ১০ দিন পিছিয়ে দিয়ে ২৭ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। নিয়তি বলে কথা, সেই ২৭ আগস্ট অনেক পরীক্ষার্থীদের এক কোমর সমান পানিতে সাঁতরিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থাতে পরীক্ষার শুরুর সময় ১ ঘন্টা পিছিয়ে ১১টায় শুরু করেছে। গত ২দিন ধরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আবহাওয়া ভালো যাচ্ছে না। সমুদ্রে নিম্নচাপ চলছে, বৃষ্টির তীব্রতা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তবে গতকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতাসহ পাহাড় ধসের ঘটনা নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগে ফেলছে। বার বার সতর্কতার পরও পাহাড় থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে অসহায় বাবা ও সন্তানকে।
বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন আগামী দিনের বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির জন্য। পৃথিবীর তিন ভাগ পানি হলেও এর জন্যই মানুষকে ভুগতে হয়। একদিকে মিষ্টিপানির সংকট, অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণে রুদ্ধ পানি নিষ্কাশন পথ। উন্নয়নের ছোঁয়া আজ প্রায় সবখানেই। বাড়ির সামনেই এখন চকচকে রাস্তা, উড়াল পথ। রয়েছে আধুনিক নগরীর স্বপ্নও। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। ফলে নামে বন্দরনগরী, বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও উন্নতি হয়নি নাগরিক পরিষেবার। সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে থইথই করে নগরীর নিম্নাঞ্চল । ড্রেনের নোংরা পানিতে ভরে যায় নিচু বাড়িগুলো। উপচানো নোংরা পানি ঢুকে পড়ে ঘরে। পুরো মহানগরীই পানিতে টইটম্বুর। বৃষ্টি থামলেও সে পানি সহজে নামে না। আর নামবেই বা কোথায়? তারও তো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পথ চাই। এই পথ তৈরিতে এরই মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসার খরচ হওয়া ১৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা শ্রাদ্ধের পর সুফল হিসেবে মহানগরবাসী পেয়েছে নালা নর্দমায় পড়ে ‘সলিল সমাধির মত নগর’।
জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম মহানগরীর পুরোনো সমস্যা। গত কয়েক দশক ধরেই মহানগরবাসীকে এ সমস্যাকে সঙ্গী করেই বসবাস করতে হচ্ছে। যদিও নগরবাসীকে নানা স্বপ্ন দেখিয়ে দফায় দফায় নেওয়া হয়েছে নানা প্রকল্প। গত কয়েক দশকে নেওয়া এরকম একাধিক প্রকল্পের দৃশ্যমান ফল একসময় বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরী হাঁটুপানিতে ডুবলেও এখন ডুবছে কোমরপানিতে। কোথাও কোথাও তা গলা ছাড়াতে পারলেই যেন খুশি হয়। অর্থাৎ পুরোই সাঁতার। আর সেই পানিতে ডুবেই ৭ আগস্ট মর্মান্তিক মৃত্যু হয় কলেজ ছাত্রী নিপা পালিতের।
নগরবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগকে পুঁজি করে নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ পুরোদমে চললেও অবস্থা ‘যে-কে-সেই’। প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যাকে ‘অর্থশ্রাদ্ধ উৎসব’ বলা হয়েছে। উন্নয়নের নামে নগরীকে আরও বেশি জলাবদ্ধতায় আবদ্ধ করার এই যে প্রক্রিয়া, সে দায়ও নগর কর্তৃপক্ষের কেউ স্বীকার করছেন না। এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সাল থেকে পাহাড় ধসে এ অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫১ জন। ৭ আগস্ট বিকালেও কক্সবাজারে পাহাড় ধসে মা ও মেয়ের মৃত্যুর খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এর আগে চকরিয়া উপজেলায় পাহাড় ধসে মাটির দেয়ালচাপায় এক পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর বেদনাদায়ক খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। গত এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অনেক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। রাঙামাটিতে ১৯৭ জায়গায় ভূমিধসের খবর এসেছে। ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে মাটি এবং বন্যার পানি মহাসড়কে এসে পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দরবানে। পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যান চলাচল এই সম্পাদকীয় লেখার সময়েও বন্ধ ছিল। রাস্তায় আটকা পড়েছে শত শত যানবাহন।
আমাদের স্মরণে আছে ২০১৭ সালে একযোগে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় শুধু রাঙামাটিতেই নিহত হয়েছিলেন ১২০ জন। বৃষ্টি, বর্ষা, বন্যা, পাহাড়ধস প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এর মাঝে অস্বাভাবিকতা হলো আমাদের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতা। বর্ষায় অতিরিক্ত বর্ষণের পানি পথেঘাটে জমতেই পারে। কিন্তু তা থেকে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে, নগরীর পথে যানবাহন হিসেবে নৌকা উঠে আসবে সেটা কোনোমতেই স্বাভাবিক নয়। এমন জলাবদ্ধতার পেছনে যেমন রয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, তেমনি রয়েছে প্রকল্পের নামে কারও কারও পকেট ভারী করার প্রবণতাও। রয়েছে আমাদের অসচেতনতাও। বিশেষত পাহাড় ধসে মৃত্যুতে। আমরা পাহাড় কেটে তাকে দুর্বল করছি। ফলে পাহাড় ধসে পড়ছে। আমরা উন্নয়নের নামে পাহাড়ের গাছ কাটছি। ফলে বৃষ্টিতে পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারাচ্ছে। আবার আমরাই পাহাড়ের ঢালে বিপজ্জনকভাবে বসতি তৈরি করছি। এতে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটছে।
ইতঃপূর্বে পাহাড়ধস এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে বহু কথা হয়েছে। পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী খরচও কম হয়নি। এবার আমরা শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তবেই জলাবদ্ধতা ও পাহাড় ধস থেকে মুক্তি চাই নগরবাসী। পাহাড় ধসে মৃত্যু রোধে বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করি, নগরের দায়িত্বশীলদেরও ‘ঘুম’ ভাঙুক। যারা নগরীর জলাবদ্ধতা ইস্যুতে নির্বাক, তারা সবাক হোন, সচল হোন। এ নগরকে রক্ষায় সকল সেবা কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করবে- এমনটি প্রত্যাশা সকলের।