ছাপা অক্ষরের বিদ্যার অমরত্ব

147

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম দিন দিন যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের বিস্ময় আবিষ্কার কম্পিউটারের ফলে আনন্দ-বিনোদন থেকে শুরু করে যোগাযোগ ও তত্ত্ব-তথ্য আদান-প্রদান অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। সব কিছু এত সহজলভ্য বলেই আধুনিক প্রজন্ম বার বার আধুনিক প্রযুক্তিকে বেছে নেয়। তাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে একটি স্মার্ট ফোনের ভূমিকা চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আধিপত্য বিস্তার ও নিজের অবস্থান জানানোর জন্য অনেক ধরণের অপরাধ করে চলছে। বর্তমানে কিশোরদের একটি অংশ দলে দলে বিভক্ত হয়ে শহরের আনাছে-কানাছে আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হচ্ছে। কী আশ্চর্য। একটি সুন্দর শৈশবের পথ ধরে যে কিশোর বেড়ে উঠে তারা এখন কিশোর গ্যাঁংয়ের সাথে জড়িত হয়ে নানান অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিশোর শব্দটার সাথে জড়িয়ে আছে স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালবাসা-একটি জীবনের সব সুন্দর ও সুখময় অনুভূতিগুলো। অথচ আমরা এখন এমন সময় পাড় করছি যখন আমাদের সামনেই আমাদের আদরের কিশোর-কিশোরীরা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
আমাদের আদরের বাচ্চারা ঘর থেকে বের হয়ে কোথায় যায়, কার সাথে মিশে, কীভাবে সময় কাটায়, ইত্যাদী বিষয়গুলো এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তারা ঘরে বসেই স্মার্টফোনের সাহায্যে তাদের সঙ্গী-সাথীদের সাথে মত বিনিময় কালে কি করছে এই বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় যে সব কিশোর অপরাধের সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতে স্মার্টফোনের বিষয়টি আগে আসে। কোন না কোনভাবে এই কিশোরদের ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া পাওয়াকে প্রভাবিত করে। যে কোন সাধারণ ঘটনা তারা যেমন সহজে জানতে পারে তেমনি যে কোন অপরাধ সংঘটিত করতেও তারা স্মার্টফোনের সাহায্য নেয়। এই ক্ষেত্রে সামাজিক পরিস্থিতিতে অভিভাবকরাও অসহায় হয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাঁং এর সাথে জড়িত এলাকা ভিত্তিক দলগুলোর একটি নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে। প্রতিটি মুহূর্তে তারা ইঙ্গিত করছে। সহজেই যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি প্রতিটি টিভি চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকায় কিশোর গ্যাঁংয়ের উপর প্রচারিত সংবাদগুলো আমাদেরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে, আবার মাঝে মাঝে টকশোগুলো কিশোর গ্যাঁং নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে এই সমস্ত কিশোর গ্যাঁংয়ের নেপথ্যে যারা আছে তাদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে। তবুও থামে না অন্যায়। দিন দিন একটি অপরাধ থেকে আরো একটি অপরাধের জন্ম হচ্ছে। আনিসুল হক অভিভাবকবৃন্দকে সচেতন হতে অনুরোধ করেন। আমাদের বাচ্চাদের মন-মানসিকতা তাদের নিজেদের পরিবার দ্বারা অধিক প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে অভিভাকদের নজরদারিতে, স্নেহ, আদর ও শাসনে কিশোর-কিশোরীদের সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করেন। আনিসুল হক আরো বলেন, সন্তানের হাতে যন্ত্র নয়, বই তোলে দিন। বাড়িতে পত্রিকা রাখুন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এত নেতিবাচক বিষয় প্রচারিত হয় যাতে শ্বাস রোধ হয়ে আসে। তিনি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ভাষায় অভিভাবকবৃন্দকে অনুরোধ জানান, চারপাশের দরজা-জানানোগুলো খুলে দিন, আমরা একটু বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে চাই। দৈনিক খবরের কাগজ আর বই হলো সেই জানালা। এই জানালার মাধ্যমে আমাদের বাচ্চাদের সুন্দর ও সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত খবরের পিছনে একটি অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিভাবকের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, কোন এক সময় তাঁর সন্তানকে কে যেন ফোন করে বাহিরে ডেকে নিয়ে যায়। যারা ফোন করে তারা নিশ্চয়ই পূর্ব পরিচিত। তাই প্রতি জন অভিভাবককেও সন্তানদের সঙ্গী-সাথী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একটি মূল্যবান প্রবাদ আছে ‘‘সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’’ আসলেই সত্যি। প্রবাদটি পুরানো হলেও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত সংবাদে এরসত্যতা জানা যায়। এমন দুর্ঘটনার পিছনে নিজের বন্ধু-বান্ধবীরাই জড়িত। এক একটি খুন, এক একটি অন্যায় বার বার আমাদের অসেচনতাকে দায়ি করছে। তাই যন্ত্র নয়, জ্ঞানের জানালা খুলতে বইয়ের বিকল্প নেই।
ইলেকট্রনিক যন্ত্রের পড়া ও জ্ঞান বেশিদিন স্থায়ী নয় বলেই সহজে ভুলে যায়। অন্যদিকে ছাপা অক্ষরের জ্ঞান অনেক অনেক স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আধুনিকতার ছোয়াঁয় ভাবা হয়েছিল, ই-বই জনপ্রিয় হতে থাকবে, আর কাগজে ছাপা বই যাবে উঠে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে যায়। বরং দিন দিন কাগজে ছাপা বইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে। গার্ডিয়ান ও ওয়াল ষ্ট্রীট জার্নালের সূত্র মতে, পুস্তক প্রকাশে সংগঠনগুলোর হিসাবে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যে ই-বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুপাত ছিল ১ দশমিকে ৭ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কোয়ার্টজ ম্যাগাজিনে নাতাশা ফ্রষ্ট লিখেছেন, ২০১৮ সালে আমেরিকা আর ইউরোপ দুই মহাদেশেই ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে এবং ২০১৩ সালের পর কাগজে ছাপা বই বিক্রি করার দোকানের সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। পশ্চিমে অনেক ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এশিয়ায় বিক্রি বেড়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলোর বিক্রি বেড়ে চলেছে। যেখানে মোবাইল কোম্পানীগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে যাচ্ছে সেইখানে ই-বুকের জায়গায় কাগজের বইয়ের কদর প্রশংসনীয়।
বর্তমানে গুজবের মাধ্যম আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে। অধিকাংশ বড় বড় ঘটনার পিছনে গুজবকে দায়ি করা হয়। যতটুকু নয়, তার ছেয়েও অধিক হারে গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি ছেলে ধরা গুজবে সবাই খুব চিন্তিত আছে। বাচ্চাদের ঘর থেকে বের হতে দিতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। তাছাড়া নিজের বাচ্চাকে নিয়েও কেউ বের হতে সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ বাচ্চা কেঁদে উঠলে যদি জনগণের রোষানলে পড়ে, এই ভয়। রানু নামে একজন মহিলাকে পিঠিয়ে হত্যা করার ঘটনা সকলকে ব্যাতিত করেছে। পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানোর ফলে চারিদিকে ছেলে ধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজন গণ পিটুনিতে মারা যায়। তাছাড়া মানব সৃষ্ট কয়েকটি বড় বড় দুর্ঘটনার পিছনে গুজবকেই দায়ী করা হয়েছে। যে কয়েকটি বড় বড় আগুনের ঘটনা হয়েছে তাতে কারো না কারো হাত আছে বলে বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়। গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে জন সমাগম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কেউ কেউ ফায়দা লুটে নিচ্ছে। সরকারকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। কেউ কেউ ধারণা করছে, সরকার পক্ষ নিজেই কোন কোন ক্ষেত্রে গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে অন্য কোন খাতে প্রবাহিত করছে। এই গুজবের পিছনেও স্মার্টফোনের ভূমিকা অনেক।
সম্প্রতি রোহিঙ্গার বিশাল সমাবেশ সৃষ্টির পিছনে স্মার্টফোনের অনেক বড় ভূমিকা আছে। অন্য দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যে বিশাল গণ-সমাবেশ করে তাতে মোবাইলের ভূমিকাই চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাইতো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল নেটওয়ার্কের জোড় নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মানুষকে একটি আতঙ্কের মধ্যে রাখার জন্য যারা বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের সঠিক ব্যবহার করছে না তারা নিজেরাই একদিন বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। কাগজের বই আর পত্রিকার সংবাদ সত্যও বস্তুনিষ্ঠ হতে হয়। তাই ভুল সংবাদ বা ফেক নিউজ ছাপা কাগজে প্রকাশিত হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমান সময়ে একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। এই মাধ্যম অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যায়।
আত্মার সম্পর্ক স্থাপনে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। দূরের ও কাছের মানুষটির সব খবরাখবর এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। জন্ম থেকে মৃত্যু, স্কুল জীবন থেকে কর্মক্ষেত্রে ধাপে ধাপে সাফল্যের খবর, জীবনের সব রকম সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার খবরগুলো আমরা এই মাধ্যমে সহজে পেয়ে থাকি। যে কোন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো এই মাধ্যমে সহজেই পাওয়া যায়। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্তও জানা যায়। কিন্তু অনেক সময় কিছু কিছু সংবাদ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। প্রিয়জনের আনন্দ সংবাদগুলো সবাইকে আনন্দিত করে। আবার কখনো কখনো এই আপনজনকে নিয়ে দেওয়া অসত্য সংবাদগুলো সবাইকে কষ্ট দেয়। এভাবে কখন যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক সময় প্রিয়জনকে ভুল পথে পরিচালিত করে। বর্তমান অসত্য ও ভিত্তিহীন সংবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। নেটের মাধ্যমে সহজে সকল কিছু জানতে পারাতে অনেকে প্রতিদিনের খবরের কাগজগুলোর প্রধান-প্রধান সংবাদগুলো স্মার্টফোনের মাধ্যমে জানতে পারে। কিন্তু ছাপা পাতার খবরের কাগজের প্রতিটি পাতায় আছে দেশ-বিদেশের অনেক খুঁটিনাটি সংবাদ। স্মার্টফোনে পাওয়া তথ্যগুলোকে মাঝে মাঝে ভিত্তিহীন বলে বিবেচিত করা হলে সে সব তথ্যগুলো আবার প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত সংবাদগুলো ‘‘প্রিন্ট ইজ’’ গণ্য করা হয়। কোনো অসত্য সংবাদ প্রকাশিত হলে পরবর্তীতে আবার ছাপার অক্ষরেই প্রতিবাদ করা হয়। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত খবরের কাগজ ও বইয়ের কোন বিকল্প নেই। অনেকেই আজকাল ঘরে সংবাদ পত্র রাখতে আগ্রহী নয়। কয়েকটি টাকা বাঁচানোর জন্যে স্মার্টফোন নির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু একটি ছাপা অক্ষরে সংবাদপত্র একটি পরিবারের সদস্যকে অনেক ভাবে প্রভাবিত করে। একটি সমাজ ও দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান জানাতে সাহায্য করে। একটি পরিবারের বাচ্চাদের পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে। যে পরিবারে ছাপা অক্ষরের সংবাদপত্র আছে, সেই পরিবারের সদস্য প্রতিদিনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সহজেই জানতে পারে বলেই নিজেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপযোগী করে গড়ে তোলে। প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে উন্নত করতে দৈনন্দিন সংবাদপত্রের বিকল্প নেই বলেই বিসিএস ও অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের প্রতিদিনের সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া যে কোন মৌখিক পরীক্ষার কিছু কিছু প্রশ্ন শুধুমাত্র ছাপা অক্ষরের সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। এক সময় পরিবারের মর্যাদাও সংবাদপত্র নির্ভর ছিল, যাদের পরিবারে একটি সংবাদপত্র নেওয়া হত সেই পরিবারের সদস্যদেরকে সম্মানের সাথে বিবেচনা করা হত। এখনো আলোকিত পরিবারের পিছনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা চট্টগ্রাম নির্ভর সংবাদপত্র রাখেন তাদের কাছে এক নম্বর পত্রিকা হচ্ছে দৈনিক আজাদী। পরবর্তীতে দৈনিক পূর্বকোণ ও পূর্বদেশ , এরপর অন্যান্য পত্রিকার অবস্থান। আবার যারা ঢাকা কেন্দ্রীক জাতীয় পত্রিকা নেন তাদের কাছে প্রথম আলো ও ভোরের কাগজের অবস্থান শীর্ষে। এইভাবে ছাপা অক্ষরের সংবাদপত্র পারিবারিক মর্যাদার মাপকাঠিতে পরিণত হয়। ছাপা অক্ষরের গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতার বইগুলো মনের সৌন্দর্যের পাশাপাশি চারিত্রিক সৌন্দর্যকে বিকশিত করে। রুচি ও সাংস্কৃতির দিকে তারা অনেক উন্নত হয়। তাই ছাপা অক্ষরের পড়া, কাগজের পড়া একজন সুন্দর মনের মানুষ হতে, আলোকিত মানুষ হতে ও স্বনির্ভর গৌরবময় মানুষ হতে সাহায্য করে।

লেখক : অধ্যাপক,