করোনার প্রভাব জনশক্তি রপ্তানিতে রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

52

 

বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব অপরিসীম। রেমিটেন্স-প্রবাহ সরাসরি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে গতিশীল করছে, পাশাপাশি জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বিপুল বেকারত্ব লাঘব হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় অর্জনকারী ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সম্প্রতি একটি জাতীয় সহযোগী পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বিএমইটিএর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করে। পোশাক খাতের পরে জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রাখা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত। বাংলাদেশের মোট জনশক্তি রপ্তানির ৩২.১১ শতাংশই যায় সৌদি আরবে এবং দেশে মোট আহরিত রেমিটেন্স-এর ২০ শতাংশের বেশি আসে সে দেশ থেকে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছিল, তবে ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন এবং ২০১৯ সালে রপ্তানি হয় ৭ লাখ ১৫৯ জন। বাংলাদেশ থেকে যেসংখ্যক কর্মী বিদেশে যায় তার ১৫ শতাংশ নারী। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৭ লাখ নতুন কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য থাকলেও করোনা মহামারির কারণে মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন কর্মীই প্রেরণ করা সম্ভব হয়। ফলে ৫ লাখের বেশি লোক বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ হারায়। এর ওপর করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কর্মী। নানা কারণে বিদেশে শ্রমবাজার দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তির চাহিদা দ্রæত কমে আসছে, অনেক দেশ দক্ষ কর্মী ছাড়া নিচ্ছে না। বিশ্বের শীর্ষ ১০ গন্তব্য দেশগুলোর ৭৫ শতাংশ উচ্চ দক্ষ অভিবাসী। বাংলাদেশে ৫ কোটি তরুণের ১১ শতাংশ বেকার। তাছাড়া, টিআইবির তথ্য মতে, বাংলাদেশে বিদেশী দক্ষকর্মী কাজ করছে ০.১৬ মিলিয়ন এর অধিক এবং এরা বছরে প্রায় ৩.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা যদি বাড়ানো যেত তাহলে বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমের বাজার আরও সম্প্রসারিত ও টেকসই হত। আমরা জানি, দক্ষ কর্মী সৃষ্টি করে বিদেশে রপ্তানি করার জন্য সরকার ২০১৯ সাল থেকে গঠনমূলক কর্মসুচি গ্রহণ করে। এ কর্মসুচির আওতায় শ্রম রপ্তানি শুরু আগেই বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবল সব তছনছ করে দেয়। এতে দেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতের মত জনশক্তি রপ্তানি বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামসহ সারাদেশ খেকে ২০১৯ সালে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ১৫৯ জন। পরের বছর গেছেন মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে শুধু সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার জন। করোনা সংক্রমণ শুরুর বছর ২০২০ সালে সৌদিতে জনশক্তি রপ্তানি নেমে যায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জনে। ওই বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাস অবশ্য করোনা সংক্রমণের কারণে জনশক্তি রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বছরের পাঁচ মাসে সৌদিতে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৪ জন। এধারা মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাতসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকা দেশসমূহের বেলায়ও। জনসংখ্যা রপ্তানির এ নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। যদিও ২০২০ সালের হিসাবে রেমিটেন্স-এর গতিতে তেমন প্রভাব লক্ষ করা যায় নি। সূত্র জানায়, ২০২০ সালে প্রায় ৯.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি অভিবাসী ১৬৮টি দেশ থেকে ২১ হাজার ৭৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করে, যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ৩ হাজার ৩৯৭ মিলিয়ন ডলার বেশি। করোনার প্রভাবে এই সময় পারিবারিক প্রয়োজনে প্রবাসীরা বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠিয়েছে, সরকারঘোষিত ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা তাদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু এতে আমাদের আত্মতৃপ্তির কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, করোনার এ প্রভাব সকল দেশের অর্থনীেিতকে বিপর্যস্ত করেছে। এরমধ্যে বিদেশে জনসংখ্যা রপ্তানিও আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। বিষয়টি এখনাই অনুধাবন করতে হবে। জনসংখ্যা রপ্তানির বিষয়ে সরকারকে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ক‚টনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধিসহ দক্ষকর্মী তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করি, সহসা আধাঁর কেটে যাবে, আলো ফুটবে, সাথে বাড়বে রেমিটেন্স প্রবাহের গতিও।