ইয়াসের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছে বেড়িবাঁধ উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

10

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস দেশের কোথাও বড় ধরনের আঘাত না আনলেও এর অভিঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েগেছে সমুদ্র ও নদীর উপকুলীয় এলাকার বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্টি সাগরের উত্তাল ঢেউ বেড়িবাঁধ ভেঙে উপছে পড়েছে উপকুলীয় এলাকায়। ফলে দেশের অধিকাংশ উপকূলীয় এলাকা ও নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জনজীবনের। ইয়াসেরে বুঝা গেলে কত অরক্ষিত আর অবহেলায় পড়ে আছে দেশের বিশাল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। সূত্র জানায়, ২২টি উপকূলীয় জেলায় সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ বসাবাস করে থাকে। প্রতি বছরই ছোটবড় ঘূর্ণিঝড়, তুফান ও অতিবৃষ্টি উপকূলবাসীকে তাড়া করে ফেরে। এসময় নড়বড় বাঁধ-এর কারণে চরম আতঙ্কে দিন কাটে উপকূলবাসীর। গত বুধবার সকালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে আঘাত হানার পর ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষীপুরের ৩১ টি উপজেলায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, যাতে উল্লেখযোগ্যহারে ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ইলেক্ট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিভিন্ন প্রতিবেদনে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
বিশেষ করে দ্বীপ সেন্টমার্টিন ও কুতুবদিয়ার বাঁধ, সড়ক ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। সেন্টমার্টিপনা ১০ হাজারের অধিক জনঅধ্যুষিত দ্বীপটির অর্ধেকের বেশি মানুষ আশ্রয়চ্যুত হয়েছে। এছাড়া জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও নগরীর নিম্নাঞ্চল, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূল প্লাবিত হয়েছে। এককথায় উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম; তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ভেসে গেছে মাছের ঘের। বিভিন্ন স্থানে নদীতে বিলীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু বাঁধ। এতে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় অনেকে আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার ওপরে। কোথাও কোথাও রাস্তা ভেঙে ব্যাহত হয়েছে যোগাযোগ। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুসহ ৭ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের ১৯ জেলার ১৪৭ উপজেলার ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই এখন নাজুক হয়ে পড়েছে। নামে মাত্র থাকা উপক‚লের বেড়িবাঁধ সংস্কার ও মেরামতের নামে প্রতি বছর চলে সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি অর্থের লুটপাট। ঠিকাদার, প্রকৌশলী আর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বরাদ্দের অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়ার কারণেই উপকূলে নামকাওয়াস্তে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়। সামান্য জোয়ারেই সেসব বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয় প্রতি বছর। দুই বছর আগের ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে মাইলের পর মাইল বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে তালিয়ে যায় ফসলি জমি, বহু জনবসতি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের পর বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপক‚লীয় এলাকায় যে বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ হয়েছিল তা অনেকটা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও সংস্কারের নামে অর্থের অপচয় হয়েছে বটে টেকসই নির্মাণ হয়নি। এর পরবর্তীতে সিডরের ১৩ বছর পরও দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়নি। পিছিয়ে থাকা এ জনপদগুলোর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না কোনোভাবেই।
উপকূলীয় বাসিন্দাদের সুরক্ষিত রাখতে সরকার শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তাদের ঝুঁকিমুক্ত জীবন নিশ্চিত হচ্ছে না কোনোভাবেই। উপক‚লের বিপুল জনগোষ্ঠী জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। এরপরও উপকূলের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। বিস্তীর্ণ উপকূলীয় জনপদকে সুরক্ষায় টেকসই উন্নয়ন পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ইয়াসে যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহায়তায় দ্রুত সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে।