ইন্টারনেট অভ থিংস

77

সাফ্ফাত আহম্মদ খান

স্মার্ট বলতে আমরা আগে বুঝতাম সুর্দশন ও পরিপাটি বা চালাক ব্যক্তি কিন্তু স্মার্ট শব্দটির সাথে ডিভাইস শব্দটি যোগ করলেই এটার মানেটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। স্মার্ট ডিভাইস কী তা আমরা সবাই জানি। স্মার্ট শব্দটি এখন আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। নিজেই চিন্তা করুন স্মার্ট ডিভাইস ছাড়া আমাদের একদিনও কি চিন্তা করা যায়? মোবাইল ফোন, টিভি, ক্যামেরা, লাইট, ফ্যান ইত্যাদি সহ আমাদের দৈনন্দিন সকল কাজে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজ আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আইওটি। স্মার্ট ডিভাইসের সাথে আইওটি’র একটি যোগসূত্র আছে। ‘আইওটি’ সংক্ষিপ্ত রূপটির পূর্ণাঙ্গ কথা হচ্ছে ইন্টারনেট অভ থিংস। যখন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি একটা আরেকটার সাথে ইন্টারনেট দ্বারা যুক্ত থাকবে এবং তাদের মধ্যে ডাটা আদান-প্রদান করবে সেই সিস্টেমটাকেই বলা হয় আইওটি। সহজ কথায় স্মার্ট ডিভাইস যখন ইন্টারনেট দ্বারা যুক্ত থাকবে তখন তাকে আইওটি ডিভাইস হিসাবে সঙ্গায়িত করা যাবে। আইওটি হলো এক ধরনের ইন্টারনেট কানেকটেড নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক কিন্তু কোনো ব্যক্তির সাথে ডিভাইস বা ডিভাইসের সাথে ব্যক্তির নয়। এই নেটওয়ার্ক হলো ডিভাইস টু ডিভাইস। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, আপনি জরুরি কাজে বাসা থেকে বের হলেন। অর্ধেক পথ আসার পর আপনার মনে হলো বাসার লাইট, ফ্যান, এসি বন্ধ করা হয়নি। এখন হয় আপনাকে বাসায় ফেরৎ গিয়ে সেটি সমাধান করতে হবে না হয় সারাদিন এই ব্যাপার নিয়ে টেনশন করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি আপনার মোবাইল থেকে গাড়িতে বসেই বাসার ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে ব্যাপারটি আপনার জন্য কত সহজই না হতো। দূর থেকে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে ইন্টারনেট অভ থিংস। এরকম আরো অনেক কাজ ম্যাজিকের মতো করা যায়। যেমন, আপনার গাড়ি বা মোটরসাইকেলের লোকেশন জানা এবং প্রয়োজনে দূর থেকেই আপনি ইঞ্জিন চালু বা বন্ধ করে দিতে পারবেন। আপনি বাসার বাইরে থেকেও পানির মোটর ছেড়ে ছাদের ট্যাংকে পানি তুলতে পারবেন। আপনার ফ্রিজ বলে দেবে ভিতরে কী কী খাবার আছে। আপনি বাসায় আসার আগেই এসি ছেড়ে রুম ঠাÐা করে রাখতে পারবেন ইত্যাদি। আর এখন তো বাসায় গুগল এসিস্ট্যান্ট এবং অ্যালেক্সার মতো ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে যা ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে আপনার সাথে কথা বলবে, গান শোনাবে।
আসলে আইওটি’র ব্যাপ্তি অনেক। প্রতিদিন নতুন নতুন ডিভাইস যোগ হচ্ছে। আইওটি’র কল্যাণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা, চিকিৎসা গবেষণা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আইওটি ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে আরো প্রায় ১ ট্রিলিয়ন সেন্সর ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হবে। আইওটিকে কখনও কখনও আইওই (ইন্টারনেট অভ এভরিথিং)ও বলা হয়। ১৯৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলজি’র গবেষক কেভিন অ্যাশটন সর্বপ্রথম ইন্টারনেট অভ থিংস শব্দটি ব্যবহার করেন। তার হাত ধরেই আরএফআইডি-এর ব্যবহার প্রসারিত হয়। তিনি নেটওয়ার্কের দ্বারা সেন্সরের ব্যবহার প্রসারিত করেন যা তিনি ইন্টারনেট অভ থিংস নামে পরিচিত করান সবাইকে। আমরা আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে আইওটি ডিভাইসের ওপর নির্ভর করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশেও কলেজ-ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন আইওটি ডিভাইস এবং রোবটিক্স নিয়ে সাফল্যের সাথে কাজ করছে।
আইওটি ডিভাইস মূলত সেন্সর মড্যুল নিয়ে তৈরি। এটি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এই দুইয়ের সমন্বয়ে কাজ করে। শিক্ষার্থীরা আরডুনো, রাসবেরি পাই ও নোডএমসিইউ ইত্যাদি বোর্ডের সাথে বিভিন্ন সেন্সরের সমন্বয়ে প্রজেক্ট তৈরি করে থাকে। কারো যদি আগ্রহ থাকে তাহলে নিজেই এই ডিভাইসগুলো সংগ্রহ করে নিজের আইডিয়া দিয়ে প্রজেক্ট তৈরি করতে পারেন আর আপনাদের সাহায্য করার জন্য ইউটিউব ও গুগল মামাতো আছেই। যে হারে এর প্রসার হচ্ছে, আইওটি ডিভাইসও হ্যাকিংয়ের বাইরে নয়। তাই আইওটি ডিভাইস ব্যবহারের নিরাপত্তা নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক গবেষক শঙ্কিত। সাইবার অপরাধীরা আইওটি ডিভাইসে হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। আপনারা ইংরেজি সিনেমায় দেখে থাকবেন সিসিটিভি হ্যাক করার দৃশ্য বা কোনো শহরের ট্রাফিক সিস্টেম হ্যাক করে নিজের কাজ হাসিল করা কিংবা ডিভাইস হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে শত্রæর গোপন কথা শোনার দৃশ্য। এসবই আইওটি হ্যাকিং। আমরা সিনেমায় যা দেখি বাস্তবেও আসলে তেমনটিই হয়। চিন্তা করুন, আপনি আপনার বাসার নিরাপত্তার জন্য ক্যামেরা লাগিয়েছেন এবং সেটি আপনি বাইরে থেকেও মনিটর করতে পারেন। এখন হ্যাকার যদি আপনার ডিভাইসটি হ্যাক করে ফেলে তাহলে আপনার বাসার প্রাইভেসি বলে আর কিছু কি থাকবে? আপনি বø্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে পারেন তখন। এরকম অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে। আইওটি ডিভাইসের আর একটি ব্যাপার হলো এটি পরবর্তী প্রয়োজনের জন্য তথ্য সেভ করে রাখে। এ তথ্য থাকে ডিভাইস প্রস্ততকারকের ক্লাউড সার্ভারে।
নিজের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিচ্ছি। কিছুদিন আগে আমার গাড়িতে ট্রেকিং ডিভাইস লাগানোর প্রয়োজন হয়। বাজারে নতুন ফিচার সম্বলিত একটি ডিভাইস লাগাই। ফিচার দেখে তো আমি অবাক। এটিতে একটি এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম দেয়া আছে। ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডিং, কার ট্রেকিং সবই আছে। মোবাইল ফোনের সিম লাগালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হয়। মোবাইল ফোন থেকে মনিটর করার জন্য একটি অ্যাপও আছে। অ্যাপের মাধ্যমে একাউন্ট খুলতে হয় এবং সেটি দিয়ে লগ-ইন করে কানেক্ট করতে হয় কিন্তু খটকা লাগল যখন দেখলাম এই অ্যাপের মাধ্যমে আমার সমস্ত ডাটা তাদের সার্ভারে সেভ করা হচ্ছে। আমার পুরাতন ট্রেকিং হিস্ট্রিও তার কাছে আছে এবং প্রতিষ্ঠানটি চাইলেই এই ডিভাইসটিতে এক্সেস করতে পারবে। তাহলে চিন্তা করুন সিকিউরিটির কী অবস্থা যদিও বাংলাদেশে আইওটি ডিভাইস হ্যাকিংয়ের ঘটনা তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত তাই বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থেকেই যায়।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ১. ডিভাইসের ফার্মওয়্যার সবসময় আপডেট রাখতে হবে। ২. অপ্রয়োজনীয় পোর্টগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ৩. এনক্রিপটেড কম্যুনিকেশন যেমন এসএসএল বা টিএসএল ব্যবহার করতে হবে। ৪. টু ফ্যাক্টর লগ-ইন চালু রাখতে হবে। ৫. শক্ত ও কঠিন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। ৬. প্রয়োজন না থাকলে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখতে পারেন।