দেশের স্থলভাগের গ্যাস কি ফুরিয়ে গেলো!

56

গ্যাস অনুসন্ধানে গত দশ বছরে বাপেক্স নতুন ১০টি ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুইটিতে বড় সাফল্য পেয়েছে। দুটিতে পেয়েছে সামান্য গ্যাস। দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের এই চিত্র হতাশ হওয়ার মতোই। ফলে বাধ্য হয়েই বিদ্যমান ক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন করে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, স্থলভাগে গ্যাসের বড় কোনও মজুত নেই। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও স্থলভাগের অনেক জায়গা জরিপ করা হয়নি। যা করা উচিত ছিল।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর বলেন, ‘গ্যাসের পরিমাণ কমছে বলেই তো আমরা এলএনজি আমদানি করতে শুরু করেছি। গ্যাস নেই এটা বলার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি গ্যাস প্রচুর আছে সেটিও বলার মতো অবস্থা নেই। আমরা বেশ কয়েকটি বড় ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করছি। এছাড়া সাগরে বড় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিও আছে। অনুসন্ধানে গ্যাস পাওয়া না গেলে যে পরিমাণ খরচ হবে তা বাংলাদেশ বহন করতে পারবে কিনা সেটাও প্রশ্ন। কাজেই বাপেক্স যেসব জায়গায় অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারবে না অথবা যেসব এলাকায় ঝুঁকি বেশি সেখানে পিএসসি’র মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজটা করানো যেতে পারে।’
সরকারের দাবি, দেশে গ্যাসের মজুত রয়েছে ৩৫.৮০ টিসিএফ। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য বলে ধরা হয়েছে ২৮.৪৭ টিসিএফ। এর মধ্যে ১৩.৭০ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে ১৪.৭৬ টিসিএফ।
পেট্রোবাংলার হাইড্রো কার্বন ইউনিট গত বছর এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের সব বড় ক্ষেত্রের গ্যাস শেষ হবে। তাই সরকার প্রাথমিকভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি শেষ হলে আমদানির কোনও বিকল্পও থাকে না। এজন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছর আরও একটি টার্মিনালের কাজ শেষ হবে। এছাড়া প্রতিদিন তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারে এমন তিনটি স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে মিল না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বাপেক্সকে কাজ দেয় সরকার। প্রথমে ১০৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা করা হয়। পরে তা বাতিল করে নতুন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় হলো তার কী হবে?’
তিনি বলেন, ‘গ্যাসের মজুত আছে কী নেই তা সঠিক করে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সাগরে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করার কথা এখন পর্যন্ত হয়নি। সবমিলিয়ে কী পরিমাণ খনিজ আমাদের দেশে আছে তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাসের মজুত নিয়ে লুকোচুরি চলছে বহুদিন ধরেই। ফলে আসল তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এদিকে সংকট দেখিয়ে বাইরে থেকে বেশি দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। অথচ দেশে গ্যাস আছে কী নেই তা-ই আমরা এখনও নিশ্চিত না।’
সাফল্য যখন হতাশ করছে : নোয়াখালীর সুন্দলপুরে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর বাপেক্স কূপ খনন শুরু করে। পরের বছর ১৭ আগস্ট পেট্রোবাংলা জানায়, গ্যাস মিলেছে সুন্দলপুরে। ওই সময় দৈনিক ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে এমনটিই আশা করা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে সেখানে আরও কূপ খনন করে উৎপাদন বৃদ্ধির ঘোষণাও করা হয়েছিল। সাত বছর ৬ মাস পর দেখা গেল সুন্দলপুর থেকে দৈনিক মিলছে ৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। নতুন কোনও কূপও আর খনন করা হয়নি।
২০১২ সালে গাজীপুরের কাপাসিয়ার অনুসন্ধান কূপে গ্যাস না পাওয়ায় কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাপেক্স।
২০০৯ সালে সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে পেট্রোবাংলা বলেছিলে, সেখানে ৪ থেকে সাড়ে চার টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। গ্যাস আছে কিনা জানতে ২০১২ সালে দ্বিমাত্রিক জরিপ করে বাপেক্স। জরিপে বিশাল গ্যাসের আধার থাকার সম্ভাবনা দেখতে পায়। ২০১৩ সালের মার্চে কূপে গ্যাস না পাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে রূপগঞ্জে কূপ খনন শুরু করে বাপেক্স। মাটির নিচে ৩ হাজার ৬১৫ মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করে গ্যাসের সন্ধান পায় সংস্থাটি। গ্যাস পাওয়ার আড়াই বছর পর ২০১৬ সালের মার্চে গ্যাস তোলা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এখানে গ্যাসের পরিমাণ এত কম ছিল যে, এখন সেখান থেকে গ্যাস তোলার কাজ শুরুই করেনি বাপেক্স। অনেকেই বলছেন প্রসেস প্ল্যান্ট আর পাইপ লাইনের খরচ ওঠানোই কঠিন হবে।
২০১৪ সালের আগস্টে পাবনার মোবারকপুরে কূপ খননের কাজ শুরু করে বাপেক্স। ৪ হাজার ২০০ মিটার খননের পর গ্যাস পাওয়া গেলেও সেটি বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হওয়ায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে অগভীর সমুদ্রের ১৬ নম্বর বøকের মগনামায় যৌথভাবে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্স ও অস্ট্রেলিয়ার বহুজাতিক কোম্পানি সান্তোস। ফেব্রæয়ারির শেষ দিকে অনুসন্ধান কাজ শেষে ওই কূপে উল্লেখযোগ্য কোনও গ্যাসের মজুত পায়নি বাপেক্স।
২০১৮ সালে আবার দুই খনিতে ব্যর্থ বাপেক্স ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা-৪ এবং কসবা-১ কূপে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস পায়নি বাপেক্স। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সালদার পাশে রুখিয়া এবং কসবার পাশে কোনবান থেকে গ্যাস তুলছে। একই ভূকাঠামো হওয়ায় বাংলাদেশ অংশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করা হলেও তা করা হয়নি।
তবে আশার কথা হচ্ছে ভোলাতে নতুন গ্যাস পওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাপেক্স। তবে ভোলায় আগেও গ্যাস পাওয়া যাওয়াতে ভোলা নর্থকে একেবারে নতুন ক্ষেত্র মানতে নারাজ অনেকে।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমদ ফারুক চিশতী বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে যেসব জায়গায় এখনও গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়নি সেসব জায়গা আগে জরিপ করতে হবে। পাশাপাশি অনুসন্ধান কূপ খনন করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে গত ১০ বছরে যেসব অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে তাতে কিছু ভালো গ্যাসক্ষেত্র যেমন পাওয়া গেছে তেমনি গ্যাস পাওয়া যায়নি এমন কাঠামোও ছিল। পশ্চিমাঞ্চল, পার্বত্য এলাকা এবং সাগরে এখনও আমার কোনও কাজ করিনি। ফলে কী পরিমাণ গ্যাস আছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমরা আমাদের জানার মধ্যে বড় বড় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন করছি এখন। যেমন, তিতাস গ্যাস ক্ষেত্র, সিলেটের বিবিয়ানা। ’