আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

199

মানুষের বুদ্ধি বিকাশের জন্য শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। দার্শনিক রুশো (১৭১২-৭৮) সাম্যবাদী সমাজের প্রত্যাশায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছেন। আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেশে দেশে শিক্ষা মানুষের মৌলিক ও জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং নিরক্ষতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন বিসতৃত হতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারেনি।
শিক্ষা বিষয়টি একটি সর্বজনীন, ব্যাপক ও বিসতৃত প্রসঙ্গ। তাই একে কোনো সংজ্ঞা বা তত্ত¡ দ্বারা সার্বিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সাধারণত শিক্ষা বলতে মন-মানসিকতার উত্কর্ষ সাধন করে সাফল্যজনক অবদান রাখাকেই বোঝায়। একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সম্পদের সুষম ব্যবহারের জন্য শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক ধাঁচে গড়া। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকূল করে শিক্ষাব্যবস্থার বিন্যাস করেছিল। পাকিস্তান আমলেও এই শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
স্বাধীনতার পর শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও কোনো কমিশনই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। দেশে অসংখ্য কেজি স্কুল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার কারণ বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্র ও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার সংস্কারে ব্যর্থতা।
এছাড়াও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নে ব্যর্থতা, ত্রæটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন, মেধাহীন ও লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, অব্যাহত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় কম বাজেট বরাদ্দ এবং ক্রমাগত সেশনজটের কারণে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি অত্যন্ত মন্থর।
ঐতিহাসিকভাবে আমরা পেয়েছি একটি শিক্ষানীতিহীন শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার মতো বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে ক্রমেই দানা বেঁধে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ৪৬ বছরে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুণগত মানের ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। অপরিকল্পিত, কর্মবিমুখ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত থাকার ফলে শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ফলে কত সহজে কম পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাস করা যায় সেদিকেই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। সেজন্য মুখস্থবিদ্যা ও প্রচলিত নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
এ প্রবণতার সুযোগে কোচিং সেন্টারগুলো রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষকরা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার চেয়ে কোচিং সেন্টার কিংবা প্রাইভেট পড়ানোর প্রতিই বেশি মনোযোগী। অন্যদিকে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারিভাবে স্কুল-কলেজসহ এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেখানে টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব। শিক্ষাঙ্গনে নকল প্রবণতা অব্যাহত থাকার কারণেও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন, দুর্নীতি, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি প্রভৃতি কারণে অভিভাবকদের মনে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাই যে সব কারণে শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি ঘটেছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হলে সার্বিকভাবে শিক্ষার মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক গুণাবলি অর্জন ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে।