গজ্জালী-এ জমান অধ্যক্ষ আল্লামা মুসলেহ উদ্দিন (রহ.)

98

অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান

এ বসুন্ধরায় ক্ষণে ক্ষণে কত মানব-মানবীর আগমন-প্রস্থান ঘটছে। কয়জনকেই বা আমরা স্মরি ? সবাই স্বীয় নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে না পারলেও কদাচিৎ এমন কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা তাঁদের কীর্তি আর দীপ্তময় কর্মকাÐ দ্বারা সবার হৃদয় মানসপটে চিরজাগরুক ও স্মরণীয় হয়ে উঠে। এমন এক বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভা, নিষ্কলুষ, পঙ্কিলহীন চারিত্রিক মাধুর্যতা, পার্থিব লৌকিকতাহীন জীবন এবং অনুপম আমানতদারিতার এক বিরল ব্যক্তিত্বের নাম হল অধ্যক্ষ আল্লামা মুসলেহ উদ্দিন (রহ.)। যিনি ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার অন্তর্গত জোয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৫৪ সনে দাখিল, গারাংগিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ সালে আলিম, দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৮ সালে মেধা তালিকায় ১৪তম স্থান নিয়ে ফাজিল ও ৬ষ্ঠতম স্থান নিয়ে ১৯৬০ সালে কামিল পাস করেন। আবার ১৯৬২ সালে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৬৪ সালে সিটি কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ১৯৬৬ ও ১৯৬৮সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ইতিহাস ও আরবিতে কৃতিত্বের সাথে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, তৎপরবর্তী থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মময় জীবনের প্রায় পুরোটা সময় হাওেদসর দরসের পাশাপাশি অধ্যক্ষ পদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেও ছাত্রদের পাঠদানের বিষয়ে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি। ১৯৭৮ / ৭৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নৈশকালীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কিছুদিন নিয়োজিত ছিলেন। ঐ কলেজ সরকারিকরণ করা হলে তাঁকে হয়তো মাদ্রাসা না হয় কলেজ কোন একটি চাকরি বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়। তিনি সানন্দে কলেজের চাকুরী ত্যাগ করে মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। এমন কোন বিষয় ছিল না, যে বিষয় তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন না। বৈষয়িক জ্ঞানের পান্ডিত্যের পাশাপাশি ফতোয়া- ফারায়েজ, রাজনীতি, ধর্মনীতি, আন্তর্জাতিক ও সমসাময়িক ইসলামী শরীয়তের জটিল সমস্যাবলীর উত্তম সমাধানকারী এবং উর্দু, আরবি, ফার্সি , ইংরেজিসহ বহু ভাষাবিষারদ হিসাবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে তিনি যুগের ইমাম গাজ্জালী উপাধিতে ভূষিত হন।এত উঁচু মাপের জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি সাধারণ, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনযাপন করতেন। বাহারুল উলুম, আমানতদার ও মোত্তাকি বুজুর্গ হিসাবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত ছিলেন। মুসলমানদের তথা সুন্নীয়তের ঐক্যের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবনের পরম ব্রত। ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’, ‘ইসতিজার আলা ত্তা’আত’সহ বেশ কিছু কিতাব তিনি রচনা করেন। বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক, গবেষক আল্লামা এম.এ. মান্নান (ম.জি.আ) কর্তৃক অনুবাদকৃত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ কানযুল ঈমান এর নিরীক্ষণ কার্যও তিনি সমাধা করেন। (যা মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়েছেন বলেই স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর ইন্তেকালের কয়েক দিন পূর্বে হসপিটালে রাত তিনটায় তিনি ছরকারে দো ‘আলম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আ লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায়ও দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন এবং মহিউদ্দিন নামক এক ছাত্রকে বলছিলেন- আমাকে দাঁড় করিয়ে দাও, আমার টুপি দাও, লাঠি দাও, আমার হুজুর এসেছেন, আ’লা হজরত এসেছেন)। তিনি ১৯৮২ সালে গঠিত ‘জামাতে আহলে সুন্নত বাংলাদেশ’Ñ এর মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যে পরিষদের সভাপতি ছিলেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.)। তিনি ২০০৩ ও ২০০৫ সালে জাতীয় শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসাবে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর জ্ঞানের বিশালতার কাছে সমকালীন যুগের বিজ্ঞ আলেমগণ ছিলেন শ্রদ্ধাস্পদ ও অবনত মস্তক। আজ ২৬ সফর চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তাঁর নবম ওয়াফাত বার্ষিকী। ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা এই সুযোগ্য পিতার অযোগ্য সন্তান হতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। মহান আল্লাহর কাছে আব্বা হুজুরের রফে দরাজাতসহ তাঁর ফয়ুজাত কামনা করছি।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ছোবহানিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম