স্বর্ণের সাথে বেড়েছে সিগারেট চোরাচালান

173

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধপথে মানব ও স্বর্ণসহ নানা পণ্য পাচারের ইতিহাস পুরনো হলেও বিদায় নিতে যাওয়া ২০১৯ সালে চোরাচালানের তালিকার শীর্ষে স্বর্ণের বারের পাশাপাশি উঠে এসেছে ভিনদেশি নানা ব্র্যান্ডের সিগারেটও। মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, ওমান ও সৌদি আরব ভিত্তিক সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্র লাগেজের আড়ালে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাজারে নিয়ে আসছে। শুল্ক ফাঁকির সিগারেটের এই কারবারে সব খরচ বাদ দিয়েও চোরাকারবারিদের দ্বিগুণ লাভ। বিমানবন্দর দিয়ে চোরাচালান হয়ে আসা স্বর্ণ বারের অধিকাংশরেই সর্বশেষ গন্তব্য প্রতিবেশি দেশ ভারও হলেও শুল্ক ফাঁকির ভিনদেশি সিগারেট দেশের বাজারেই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশে উৎপাদন ও বাজারজাতকৃত সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শুল্ক ফাঁকির ভিনদেশি এসব সিগারেটের চাহিদা ও চোরাচালান দুটোই সমান্তরালে বাড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানবন্দরে দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই বিমানবন্দরের বাধা পেরিয়ে আসে স্বর্ণ বা সিগারেটসহ চোরাচালানের নানা পণ্য। স্বর্ণ বা সিগারেটের চালান বিমানবন্দরে আসার আগেই কর্মকর্তাদের পকেটে চুক্তিবদ্ধ টাকা পৌঁছে দেয় চোরাকারবারিরা। বিমানবন্দরে কে কখন দায়িত্বরত রয়েছেন সেই তথ্য কর্মকর্তারাই ফোনে নিশ্চিত করেন চোরাকারবারিদের। তথ্য পাওয়ার পর বহনকারীদের সিগারেটভর্তি লাগেজসহ আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা শারজাহ, সৌদি আরবের জেদ্দা কিংবা ওমান বিমানবন্দর দিয়ে ফ্লাইটে তুলে দেন চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। ফ্লাইট অবতরণের পর বহনকারীকে সিগারেটভর্তি লাগেজসহ বিমানবন্দরের বাধা ডিঙাতে বেগ পেতে হয়না। চুক্তির হেরফের কিংবা নির্ধারিত কর্মকর্তা কোনও কারণে দায়িত্বে না থাকলেই কেবল ধরা পড়ে সিগারেটের চালান। সর্বশেষ গতকাল শনিবার শাহ আমানত বিমানবন্দরে শারজাহ থেকে আসা হাটহাজারীর বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেল নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে একশ’ ৭৫ কার্টন ইজি লাইট ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।
বিমানবন্দর কাস্টমস এর যুগ্ম কমিশনার নাহিদ নওশাদ মুকুলের দাবি, কোনও চোরাচালানের সাথেই বিমানবন্দরে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ মোটেই সত্য নয়। সেরকম হলে বিমানবন্দরে চোরাচালানের এত পণ্য ধরা পড়ত না। বরং বর্তমানে দায়িত্বরত শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরদারি যে কোনও সময়ের তুলনায় বেশি হওয়ায় চোরাচালান অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।
শুল্ক অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকবছর ধরে বিমানবন্দর দিয়ে লাগেজের আড়ালে ভিনদেশি বা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিগারেট নিয়ে আসার পরিমাণ জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। কেবল চলতি ডিসেম্বর মাসেই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দরে মোট পাঁচটি পৃথক চালানে দুই হাজার পাঁচশ’ ২৩ কার্টন বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইটের কয়েকজন যাত্রী সঙ্গে করে সর্বোচ্চ এক হাজার একশ ১২ কার্টন বিদেশি সিগারেট নিয়ে আসেন। কিন্তু, বিমানবন্দরে ফটিকছড়ির বাসিন্দা হাফিজ মো. হাসান নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে একশ’ ৭৪ কার্টন সিগারেট জব্দের পর বাকিরা সিগারেট ফেলে সটকে পড়ে। এছাড়া, গত ৭ ডিসেম্বর একশ’ ২১ কার্টন, ১১ ডিসেম্বর সাতশ’ ৭৩ কার্টন এবং ১৬ ডিসেম্বর দুইশ’ ৪৭ কার্টন সিগারেট জব্দ করা হয়। জব্দকৃত সিগারেটের বেশিরভাগই ‘ইজি’ ও ‘ডানহিল’ ব্র্যান্ডের। তার আগে গত নভেম্বর মাসে ব্যাপক হারে স্বর্ণ ও সিগারেট চোরাচালান হয়। বিমানবন্দরে ধরাও পড়ে কয়েকটি। এর মধ্যে গত ৮ নভেম্বর শারজাহ থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরে আসা এয়ার এরাবিয়ার ফ্লাইটের মোহাম্মদ আবু আল হাসান নামের এক যাত্রীর লাগেজ থেকে ডানহিল ব্র্যান্ডের একশ’ ৩৬ কার্টন সিগারেট জব্দ করা হয়। গত ২২ নভেম্বর সৌদি আরবের মদিনা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আসা ২৯ জন যাত্রীর কাছ থেকে কোটি টাকার মূল্যের ৭ হাজার একশ’ ৮৩ মিনি কার্টন সিগারেট জব্দ করা হয়। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল ফেল্ট (এক ধরনের ফোম) আনার ঘোষণা দিয়ে ‘৩০৩’ ও ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের ৬৫০ কার্টন সিগারেট আনা হয়। যার মূল্য ১৩ কোটি টাকা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, বিমানবন্দরে এ পর্যন্ত আটক হওয়া বিদেশি সিগারেটের মধ্যে সেটিই সর্ববৃহৎ চালান। ওই বছরের ৭ মে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার শলাকা সিগারেট জব্দ করা হয়।
একইভাবে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সর্বশেষ স্বর্ণ চালান আটক করা হয়েছে গত আট ডিসেম্বর। দুবাই থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে ২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় ওই যাত্রীকেও আটক করা হয়েছে। ওইদিন দুবাই থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি সকালে অবতরণের পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা যাত্রীদের তল্লাশি শুরু করেন। তল্লাশির একপর্যায়ে হাটহাজারীর চারিয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ওহিদুলের কাছে ২০টি স্বর্ণের বার ও কিছু বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায়। কোটি টাকা বাজার মূল্যের জব্দকৃত স্বর্ণের বারের ওজন দুই কেজি তিনশ’ ৪০ গ্রাম। তার আগে গত ১১ই নভেম্বর আবুধাবি থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে করে দেশে ফেরেন ফটিকছড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান খান। ওই যাত্রী লাগেজের ভেতরে চার্জ লাইটের ব্যাটারির জায়গায় লুকিয়ে আট কেজি দুইশ’ গ্রাম ওজনের ৭০ টি বার নিয়ে আসেন। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত শুল্ক ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা স্বর্ণ জব্দের পাশাপাশি তাকে আটক করেন। যার বাজার মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। তার ঠিক দশ দিন পর গত ২২ নভেম্বর আবার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক যাত্রীর আগমন কমপ্লেক্সের টয়লেট থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একই আকার, ওজন ও সমমূল্যের আরও ৭০ টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়।
দেশে প্রচলিত আইনানুযায়ী সব সিগারেটের প্যাকেটে ‘ছবিযুক্ত সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা’ এবং ‘রাজস্ব স্ট্যাম্প’ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকলেও শুল্কফাঁকির ভিনদেশি এসব সিগারেটের প্যাকেটে সে ধরণের কিছুই থাকে না। এমনকি মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখও নেই। বিদেশি সিগারেট আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। দেশের বাজারে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ভিনদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। এসব সিগারেট থেকে আমদানি শুল্ক আদায় করতে পারলে বছরে প্রায় একশ’ ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়ত। দেশি প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রির চেয়ে খুচরা বিক্রেতারা শুল্ক ফাঁকির সিগারেট বিক্রি করলে পাঁচগুণ বেশি মুনাফা পায়।নগরীর বিভিন্ন অভিজাত শপিং মল ছাড়াও পাইকারি পণ্যের বৃহত্তম বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারে ৩০ থেকে ৪০টি দোকানে প্রকাশ্যেই প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। নগরীর তিনটি পাইকারি বাজারে প্রতিদিন প্রাায় ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকার চোরাচালানের সিগারেট কেনাবেচা হয়। সে হিসাবে মাসে প্রায় আট কোটিরও বেশি টাকার অবৈধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে দাঁড়ায় ১০০ কোটি টাকা।
শীর্ষ চোরাকারবারিদের আইনের আওতায় আনতে না পারার কারণেই আকাশ কিংবা স্থলপথে চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন মহানগর দায়রা আদালতে নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, স্বর্ণ জব্দের প্রায় সবকটি মামলার এজাহার থেকে শুরু করে তদন্ত শেষে দাখিল করা চার্জশিট পর্যন্ত কেবল গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকেই আসামি কিংবা অভিযুক্ত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিচারের আওতায়ও আসে শুধু চালানের বাহক। বিচার শেষে রায়ে বহনকারীর শাস্তি হলেও শীর্ষ পর্যায়ের চোরাকারবারিরা আড়ালেই থেকে যায়। স্বর্ণ জব্দের মামলা তদন্তে পুলিশ আড়ালে থাকা শীর্ষ চোরকারবারিদের চিহ্নিত করতে পারে না। শীর্ষ চোরাকারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে চোরাচালান রোধ করা সম্ভব নয়।