বিদেশিদের ভুল বোঝানো হচ্ছে

18

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ‘বিভ্রান্তি’ ছড়াচ্ছে, স্বাধীনতাবিরোধীরা ‘ষড়যন্ত্র’ করছে, বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের ‘ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে’ মন্তব্য করে এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহব্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। দেশ-বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নানা ষড়যন্ত্র করছে এই অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য। তারা মিথ্যা-বানোয়াট-কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিদেশে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
জনগণের ভাগ্য নিয়ে কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি রাখার আহব্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে কোনভাবেই ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না। জনগণই ক্ষমতার উৎস। আমরা জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করি। তাই জনগণের সঙ্গেই আমাদের অবস্থান।
তিনি বলেন, ২০২৫ সালে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে। সরকরের এ মেয়াদে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক আর যত শক্তিশালীই হোক, তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং হবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এ ব্যাধি দূর করতে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই ‘বিপ্লব সাধিত’ হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে দেশে ‘ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার স¤প্রসারণ এবং গুণগত মানোন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু ২০১৯-২০ বছরে ৭২ দশমিক ৮ বছরে উন্নীত হয়েছে। ৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮ ও অনুর্ধ্ব-১ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৫-তে হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে। খবর বিডিনিউজ’র
প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের ৭ হাজার ৬২৪টি এমপিও-ভুক্ত মাদ্রাসায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে মাসে ২৭৬ কোটি টাকা বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে নতুন ৪৯৯টি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
মহামারীর সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেন সুবিধা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষ ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে’ সক্ষম হয়েছে। দেশে প্রায় ৬ লাখ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।এ খাতের উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে পূঁজি সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে, তেমনি খুলে দিবে সম্ভাবনার দ্বার। আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী করে গড়ে তোলার যাবতীয় উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করছি।
তিন বছর পূর্তির দিনে গত ১৩ বছরের উন্নয়নগাথা তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; জনগণকে বললেন আগামীতেও আওয়ামী লীগের পাশে থাকতে। তিনি বলেন, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর ‘আস্থা রাখার কারণে’। আওয়ামী লীগ সরকারে এসে গত ১৩ বছরে কী কী করেছে, তার মূল্যায়নের ভার জনগণের ওপর দিয়েই শেখ হাসিনা বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, আমরা যেসব ওয়াদা দিয়েছিলাম, আমরা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো তিন মেগা প্রকল্পের কাজ যে এ বছরই শেষ হচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য ‘অবকাঠামো উন্নয়নের মাইল ফলক বছর’।
বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের স্তর থেকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে যেসব বড় অবকাঠামো প্রকল্প সরকার নিয়েছিল, তার মধ্যে পদ্মা সেতু (সড়ক) আসছে জুনে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর অক্টোবরে উদ্বোধন করা হবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। ডিসেম্বরে রাজধানীবাসীর জন্য চালু হবে প্রথম মেট্রোরেলের আংশিক সেবা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেক ষড়যন্ত্রের জাল আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করতে যাচ্ছি। এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে।”
বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারীর সংকট যে এখনও কাটেনি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সবাইকে শিগগিরই টিকা নেওয়ার আহŸান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, চলতি মাস থেকে গণটিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতি মাসে এক কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার কর্মসূচি নিয়েছে তার সরকার।
তিনি বলেন, মহামারীর কারণে এক গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে আমাদের বিগত ২০২০ এবং ২০২১ সাল অতিক্রম করতে হয়েছে। সেই সঙ্কট এখনও কাটেনি। এর মধ্যেই আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের এখনই সাবধান হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যারা টিকা নেননি তাদের দ্রæত টিকা নেওয়ার অনুরোধ জানাই।
দেশে এখন পূর্ণোদ্যমে টিকাদান কার্যক্রম চলছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, এখন পর্যন্ত ১২ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৭ কোটি ৫৮ লাখ এবং দুই ডোজ পেয়েছেন ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৮২ হাজার মানুষ।
সব মিলিয়ে দেশের ৪৪ শতাংশের বেশি মানুষ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন, দুই ডোজ পেয়েছেন ৩১ শতাংশের বেশি নাগরিক। এছাড়া গতমাস থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের হাতে সাড়ে ৯ কোটির বেশি ডোজ টিকা মজুদ আছে।
মহামারী যে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ‘গভীর ক্ষতের’ সৃষ্টি করেছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়েছে, নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তবে, আমরা তা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং বিভিন্ন উদার-নৈতিক আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
করোনা ভাইরাসের অভিঘাত মোকাবিলা করেও গত অর্থবছরে দেশের জিডিপি ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে বেড়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে।