প্রতিশ্রুত রাসুল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

36

 

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়্যাতের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ হলো, পূর্ববর্তী নবীগণ কর্তৃক তাঁর শুভাগমনের সুসংবাদ প্রদান। আল্লাহ তায়া’লা প্রত্যেক নবী-রাসুল থেকে অঙ্গিকার নিয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যদি তাঁদের জীবদ্দশায় প্রেরিত হন তবে তাঁর উপর ঈমান আনবেন এবং তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আল্লাহ তায়া’লা কোরআন পাকে এরশাদ করেনঃ “হে প্রিয় রাসুল! আপনি স্মরণ করুন ঐ দিনের কথা, যখন আল্লাহ তাআলা নবীগণ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন এ কথার উপর যে, যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরন করবো; তারপর তোমাদের কাছে আমার মহান রাসুল আসবেন এবং তোমাদের নব্য়ুত ও কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করবেন, তখন তোমরা অবশ্য অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে। অতঃপর আল্লাহ বলেন: তোমরা কি এ সব কথার উপর অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছো (তখন) তাঁরা সকলেই সমস্বরে বলেছিলেন, আমরা অঙ্গিকার করছি। তিনি বললেন, তাহলে এবার তোমরা একে অপরের সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সাথে মহাসাক্ষী রইলাম। অতঃপর যে লোক এই ওয়াদা থেকে ফিরে দাঁড়াবে, সেই হবে নাফরমান। (আল ইমরান ৮১-৮২)
হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম এর শুভসংবাদ: অতঃপর প্রত্যেক নবী-রাসূল নিজ নিজ যুগে আমাদের প্রিয়নবী’র আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম তাঁর প্রিয় পুত্র ও প্রতিনিধি হযরত শীস আলাইহিস্ সালামকে নুরে মুহাম্মদীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অসিয়ত করে গেছেন। আদম আলাইহিস্ সালাম আপন পুত্র হযরত শীস আলাইহিস্ সালামকে লক্ষ্য করে বলেন: “হে প্রিয় বৎস। আমার পরে তুমি আমার খলিফা। সুতরাং এই খেলাফতকে তাকওয়ার তাজ ও দৃঢ় এক্বিনের দ্বারা মজবুত করে ধরে রেখো। আর যখনই আল্লাহর নাম যিকির (উল্লেখ) করবে তার সাথেই হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামও উল্লেখ করবে। তার কারন এ যে, আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তী থাকা অবস্থায়ই তাঁর পবিত্র নাম আরশের পায়ায় (আল্লাহর নামের সাথে) লিখিত দেখেছি। এরপর আমি সমস্ত আকাশ ভ্রমণ করেছি। আকাশের এমন কোন স্থান ছিলনা যেখানে হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম মুবারক অংকিত পাইনি। আমার রব আমাকে বেহেস্তে বসবাস করতে দিলেন। বেহেস্তের এমন কোন প্রাসাদ ও কামরা পাইনি যেখানে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম মুবারক ছিলনা। আমি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় নাম আরোও লিখিত দেখেছি সমস্ত হুরের স্কন্ধ দেশে, বেহেস্তের সমস্ত বৃক্ষের পাতায়, বিশেষ করে তুলা বৃক্ষের পাতায় পাতায়, পর্দার কিনারায় এবং ফেরেশতাগনের চোখের মনিতে ঐ নাম মুবারক অংকিত দেখেছি। সুতরাং হে শীস ! তুমি এই নাম বেশি বেশি করে স্মরণ করবে। কেননা, ফেরেস্তাগণ পুর্ব হতেই এই নামে মশগুল রয়েছেন। ( জুরকানি শরীফ ২/২৩৮, খাসায়েস আল কুবরা: সুয়ূতী ১/১২-১৩ )।
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম: হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম এবং হযরত ইসমাইল আলাইহিস্ সালাম যখন আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফ তৈরি করছিলেন, তখন তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন যে, “হে আমার রব ! তুমি (এই আরব ভূমিতে আমার ইসমাইলের বংশে) তাদের মধ্য হতেই সেই মহান রাসুলকে প্রেরণ করো- যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (কোরআন সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান) শিক্ষা দেবেন এবং (বাহ্যিক ও আত্মিক) অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। (সুরা আল বাকারা ১২৯ আয়াত।
তাইতো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “আমি হযরত ইব্রহীমের আলাইহিস্ সালামের দোয়ার ফসল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার মা যখন আমাকে প্রসব করেন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে তাঁর থেকে এমন একটি নূর প্রকাশিত হল যা তাঁর সামনে সিরীয়ার বুসরা শহরের প্রাসাদগুলো সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত করে দিল। (মুসতাদরাক ১/৬০০, হা-৪১১১, তাবাক্বাত ইবনু সাদ ১/৪৬,৪৭,৭১, হা-১৮৭, ২০০, ৩৩৬, ৩৫৯)
হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম: হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম নিজ উম্মত বনী ইসরাইলকে শেষ নবীর সুসংবাদ দিয়েছেন এভাবে: “হে আমার প্রিয় রাসুল! আপনি স্মরণ করুন ঐ সময়ের কথা, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) বলেছেন: হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে রাসুল হয়ে প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার পুর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং এমন এক মহান রাসুলের সুসংবাদ দিচ্ছি-যিনি আমার পরে আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে আহমদ (সুরা আছ্ছফ ৬ আয়াত।)
তাওরাত ও ইঞ্জিল: হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমনের সুসংবাদ বিদ্যমান ছিল তাওরাত ও ইঞ্জিলে। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে তাঁর গুণাবলী এভাবেই বর্ণিত হয়েছে; যেন আহলে কিতাবগণ তাঁর গুণাবলী দেখে তাঁকে চিনতে পারে। আল্লাহ তায়া’লা বলেন: “সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী (আসল) নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দিত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্য সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। (আ’রাফঃ ১৫৭)
আহলে কিতাবরা আশা করত তারা হবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের উপর প্রথম ঈমান আনায়নকারী, যেহেতু তারা তাকে এমনভাবে জানত ও চিনত যেভাবে তারা নিজেদের সন্তানদেরকে জানত ও চিনত। আল্লাহ তায়া’লা তাদের সম্পর্কে বলেনঃ “আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাঁকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি স¤প্রদায় জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে।“ (বাকারাঃ ১৪৬)
আল্লাহ তায়া’লা আরও এরশাদ করেনঃ “যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রসূল আগমন করলেন যিনি ঐ কিতাবের সত্যায়ন করেন, যা তাদের কাছে রয়েছে, তখন আহলে কিতাবদের একদল আল্লাহর গ্রন্থকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল যেন তারা জানেই না।(বাকারাঃ ১০১)
আল্লাহ তায়া’লা অন্যত্র এরশাদ করেনঃ “আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট। (আ-ল ইমরান, আয়াত-১৬৪)
পূর্ববর্তী উম্মতগণের আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওসীলা: এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ববর্তী উম্মতগণ বিভন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিপর্যয়কালে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ওসীলা নিয়ে দোয়া করত এবং এতে তারা সফলও হত। আল্লাহ তায়া’লা কোরআন পাকে এরশাদ করেনঃ যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব এসে পৌঁছাল, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে, যা তাদের কাছে রয়েছে এবং যাঁর ওসীলায় তারা পূর্বে কাফিরদের উপর বিজয় প্রার্থনা করত। অবশেষে যখন তাদের কাছে পৌঁছলেন তিনি যাঁকে তারা চিনত, তখন তারা তাঁকে চিনতে পারেনি এবং তারা অস্বীকার করে বসল। অতএব, অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। (বাক্বরা, আয়াত ৮৯)
মহাগ্রন্থ আল কোরআন সে সুসংবাদের দিকে ইশারা দিয়েছে, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নবুয়্যাতের সত্যতা প্রমাণে এটিকে দলিল হিসেবে পেশ করেছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ কাফেররা বলেঃ “আপনি প্রেরিত ব্যক্তি নন। বলে দিন, আমার ও তোমাদের মধ্যে প্রকৃষ্ট সাক্ষী হচ্ছেন আল্লাহ এবং ঐ ব্যক্তি, যার কাছে গ্রন্থের জ্ঞান আছে। (রা’দঃ ৪৩)
পূর্ববর্তী নবীদের এ সুসংবাদ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের উপরই প্রযোজ্য। তিনি সে রাসুল যাঁর আগমনের বার্তা পূর্ববর্তীরা দিয়েছেন। কিন্তু আহলে কিতাবদের কতিপয় এ সত্য গোপন করেছে, তাদের পবিত্র গ্রন্থে যা ছিল তা অস্বীকার করল, একে তারা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল, যেন তারা জানেই না।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ