6

 

 

ঋতুচক্রে বৈচিত্র্য ও পূর্ণতার ছন্দময় শরৎ। নদীকূলে বাখাল-বিলের ধারে কাশবনে শুভ্রতার তরঙ্গায়িত নাচন। শিশিরকণার সাথে কমলা বৃন্তের শ্বেত শিউলি আর তুলতুলে সবুজ ঘাসের ঘনিষ্ঠ মিতালি। আকাশের নীলিমায় আদুরে নরম তুলোর পেঁজার মতো শুভ্র মেঘ দলের উচ্ছল ছুটোছুটি। কৃষাণ-কৃষাণীর সস্নেহ পরিচর্যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ কচি ধান গাছের ক্ষেতে ফলন সম্ভাবনার হাত ছানিতে কৃষক পল্লীতে আশা জাগানিয়া আনন্দ-গুঞ্জরণ। রঙ-বেরঙের পুষ্পরাজি যেমন মাধবী, মল্লিকা, কামিনী, বকুল, শাপলা, গোলাপ, পদ্ম প্রভৃতির প্রাচুর্যতা আর গাছ-গাছালির পত্রপল্লবে সবুজের সমারোহ। দোয়েল-শ্যামা-পাপিয়ার কলকাকলি ও রৌদ্র আর মেঘপুঞ্জের অনিন্দ্য-সুন্দর লুকোচুরিতে আলো-ছায়ার মতো মন মাতানো দৃশ্যপট। যখন শরৎ প্রকৃতি এমন মনোহারী বেশে সজ্জিত হয়ে রূপের অপরূপতায় রূপবতী ঠিক তখনই সূচনা হয় ‘মহালয়া তিথি’র। ‘মহালয়া’ মানে পিতৃপক্ষের শেষদিন ও দেবী পক্ষের শুভারম্ভ।
প্রায় ৯০ বছর ধরে মহালয়ার ভোর শুরু হয় কিংবদন্তিতুল্য বা প্রবাদ প্রতিম পুরুষ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের (১৯০৫-১৯৯১) মন মোহিত করা মায়াবী কণ্ঠের প্রাণ জাগানিয়া উচ্চারণ দিয়ে। ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে/বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর/ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা/প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত/ জ্যোতির্ময়ী জগৎ মাতার আগমন বার্তা…।’ এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসলেও তাঁর স্থলাভিষিক্ত আজো কেউ হতে পারেনি। বলছি আকাশ বাণী কোলকাতা বেতারের সংগীতালেখ্য ‘মহিষাসুর মর্দিনী’র কথা। প্রতি বছর মহালয়া’র দিন ভোরে এ আলেখ্যানুষ্ঠান না শুনলে যেনো এক অপূর্ণতা গ্রাস করে আমাদের। শাস্ত্রমতে, মহালয়ার দুটোদিক। প্রথমদিক হচ্ছে মহালয়ার দিন দেবী দুর্গামায়ের মর্ত্যলোকে আবাহন।
এ দিন মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন করে পবিত্র চন্ডী পাঠ, মহালয়ার ঘট স্থাপন ও বিশেষ পূজার মধ্য দিয়ে ঢাক-শাঁখ-কাঁসা-উলুধ্বনিতে মর্ত্যলোকে মহিষাসুর মর্দিনী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে আহ্বান করে শারদীয়া পুজোৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির কাছে আবহমান কাল থেকে আনন্দবীণায় ঝংকৃত প্রাণের উৎসব। এই উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালির অনুরাগ ও আবেগ। ধর্মীয় আবহের বাইরেও ঐতিহ্য, সামাজিক ঐক্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা আর সর্বজনীন তার ছকে শারদীয় দুর্গোৎসব গুরুত্ব বহন করে। এ উৎসব উদ্যাপনের সাথে সংগীত-নৃত্য-চিত্র-শিল্পকলারও যোগসূত্র আছে। এরই সাথে আছে পেশাজীবীদের নানান অর্থনৈতিক দিক। গত বছর বিশ্ব সংস্কৃতি বিভাগের সেরা উৎসবের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে বাঙালির শারদোৎসব ইউনেস্কো কর্তৃকও স্বীকৃত হয়েছে। আর মহালয়া থেকেই শারদীয় দুর্গাপূজার আগমনের আনন্দধ্বনি প্রকট হয়। তাই শারদীয় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ‘মহালয়া’। এ দিন আদিশক্তির আহ্বানের দিন। দেবী দুর্গাই আদ্যাশক্তি মহামায়া। দেবী দুর্গা বিভিন্ন দেবগণের অপরিমেয় তেজরশ্মি ও নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অপরাজেয় শক্তি। এখানে দেবগণ পুরুষ শক্তি আর দেবী দুর্গা নারী শক্তি। পুরুষ শক্তি ও নারী শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসেই অসুর বধ সম্ভব হয়েছিল। তারপর দেব তারাও ফিরে পেয়ে ছিলেন তাঁদের হৃত স্বর্গরাজ্য। এ পৃথিবী ও বর্তমানে মানুষ নামধারী বহুরূপী অসুরদের উৎপাতে অতিষ্ট। জগৎ সংসারের আসুরিক ও পাশবিক কর্মের হোতা মানুষরূপী অসুরদের ধ্বংস করার জন্য জগতের সকল নারী ও পুরুষকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। তবেই এ জগৎ থেকে অসুররা সমূলে উৎপাটিত হবে। নচেৎ অসুরদের উৎপাতে অশান্তির অনলে আমাদের অনবরত জ্বলতে হবে। মহালয়াতে দেবী দুর্গার আবাহনের দিনে মহালয়া উদ্যাপনের সাথে সাথে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ কাহিনী থেকে আমাদেরকে নারী-পুরুষ সম্মিলিত ভাবেই সকল ভালো কাজ করার শিক্ষাও গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
মহালয়ার দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, তর্পণের মাধ্যমে বিদেহীপূর্ব পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ দিন জলাশয়ে কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে তিল ও জল দিয়ে তর্পণ বা পার্বণশ্রাদ্ধ করে পূর্ব পুরুষদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শাস্ত্রীয় বিধি ও মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক প্রথমে বিদেহী পূর্বপুরুষ তথা পিতৃ-মাতৃকুল ও পরবর্তীতে বিদেহী শ্বশুর কুল, গুরু, বন্ধু-বান্ধব, পুত্রক-অপুত্রক, পরিচিত-অপরিচিত সকলের উদ্দেশ্যে তর্পণ বা পার্বনশ্রাদ্ধ করেই তাঁদের আত্মার তৃপ্তি সাধন করা। আবার অন্য দিকে পূর্বপুরুষের আত্মা ও তর্পণের মাধ্যমে সন্তুষ্টি লাভ করে তাঁদের উত্তর পুরুষদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আশির্বাদ করেন। ‘আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু’ (সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে তৃণরাজি- এ জগতের সকলেই তৃপ্ত হও।)- এই মন্ত্র সকল তর্পণকারীকে উচ্চারণ করতে হয়। হিন্দু শাস্ত্রে তর্পণ মন্ত্রের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, আপন-পরসহ সমগ্র ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সাম্যবাদী ভাব নিয়ে বিশ্বজনীনতার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশনা বিদ্যমান।
এই মুহূর্তে মর্ত্যকুলের বিশ্বমানব মহামারি করোনা’র বেড়াজালে আবদ্ধ। অনেক পরিবার প্রিয়জন হারানোর বেদনায় মূহ্যমান, অনেকে চাকুরি হারিয়ে উপার্জন শূন্য, আবার অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। অন্যদিকে কতিপয় অসুর সমমানুষের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হচ্ছে প্রতিদিন। মানুষ নাম ধারী অসুর কর্তৃক নারী ও পুরুষ নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, চিরচেনা ও নিত্য নতুন বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ, বৃদ্ধ মাতা-পিতার প্রতি অবজ্ঞা ও তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ, খুন, সন্ত্রাস, প্রতারণা, ভেজালের কালো উৎসব, মুনাফা লোভীদের অপতৎপরতা, উঁচু থেকে নিচুস্তরে দুর্নীতির করাল গ্রাস, ঘুষখোরদের আস্ফালন, ধর্ম ব্যবসায়ীদের অমানবিক উৎপাত, চরিত্রহীনদের ব্যভিচার, লুটেরাদের অনৈতিক প্রভাব, সবলের নির্যাতনে দুর্বলের আর্ত-চিৎকার, মাদকের ভয়াল থাবা ইত্যাদি অগণন সমস্যা ও দুর্গতির অতলগহ্বরে সাধারণ মানুষকে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। দুষ্টের দমন, মহামারিসহ সামগ্রিক দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভ ও কল্যাণময় জীবন পেতে মহালয়ার এ পুণ্যলগ্নে আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী দুর্গার করুণা প্রার্থনা করছি।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক