শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যসূচি কেমন হবে কিংবা কেমন হওয়া উচিত এই নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে চিন্তাভাবনার অন্ত নেই। সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর যেকোনো বিকল্প নেই এই বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। তবে মনে রাখতে হবে শিক্ষা আধুনিক ও জীবনমুখি হওয়া অপরিহার্য। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির চিন্তা করা মানে একটি বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেওয়া। শিক্ষাকে আধুনিক করা হলো, ঘরে ঘরে প্রযুক্তির সর্বাধুনিক উপকরণ পৌঁছে দেওয়া হলো কিন্তু তার সাথে যদি নীতি ও নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে সে শিক্ষা কখনো জীবনমুখি হয়ে উঠতে পারে না। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীর অন্তর আলোকিত করে, তার ভেতরে মানবিকবোধ জাগ্রত করে, পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে তাকেই আমরা বলতে পারি জীবনমুখী শিক্ষা।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কয়েক দফা পরিবর্তন হয়েছে। গতানুগতিক প্রশ্নপত্রের বদলে সৃজনশীল ও নৈব্যক্তিক প্রশ্নমালা সংযোজিত হয়েছে। যদিও সৃজনশীল প্রশ্নমালার জন্য যেরকম দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন তার অভাব আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। নৈব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তরদানের জন্য শিক্ষার্থীদের মূল বই পঠন পাঠনে যে আগ্রহ থাকা প্রয়োজন তাতে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি। মূল বই অনুশীলনের বদলে ছাত্র-ছাত্রীরা বাজারের ভুলে ভরা গাইড আর সহায়ক বইয়ের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি। ফলে প্রকৃত পঠন পাঠনের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামবাংলার শিক্ষার্থীরা। এ কারণে সৃজনশীল পদ্ধতির যে সুফল পাওয়ার কথা তা কার্যত কতটা পাওয়া যাচ্ছে তা বিবেচনার অবকাশ রাখে। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের আমলেই পাবলিক পরীক্ষার নামে কোমলমতি শিশুদের ওপর ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুটো পরীক্ষা। একটি পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী), অন্যটি জেএসসি ( জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট)। এই দুটো পরীক্ষা কতটা যুগোপযোগী ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। ফলে পরীক্ষা দুটো বাতিলের জোর দাবি উঠে আসছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। এই দুটো পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে দেশ ও পরিবারের কিছুই অর্জিত হয় নাই। বিপরীতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে জনগণের শ্রম ও ঘামের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়েছে যাকে রীতিমত অপচয় বললে বেশি বলা হয় না। এই পরীক্ষা দুটো মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে জিপিএ -৫ নামক একটি অশুভ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। মা-বাবার ইচ্ছার বলী হতে হয়েছে অনেক ছেলেমেয়েকে। পরীক্ষার রেজাল্টের পর ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় কত শিক্ষার্থী যে ঘর ছেড়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আর পরীক্ষার আগে নাওয়া খাওয়া ভুলে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের যন্ত্রের মতো সারাদিন এই কোচিং থেকে ঐ কোচিং ছুটতে হয়েছে। দৌড়াতে হয়েছে এই স্যার থেকে ঐ স্যারের পিছু পিছু। এতে করে পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্জনের ভান্ডারে তেমন কিছু জমা না হলেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা কোচিং সেন্টারগুলো আর এক শ্রেণির শিক্ষক কিন্তু বেশ লাভবান হয়েছে। শুধু তাই নয় গাইড আর সহায়ক বই-পুস্তকের বিপণীগুলোরও ব্যবসা হয়ে ওঠেছিল রমরমা। তাই অনেক দেরিতে হলেও এই দুটো পরীক্ষা বাতিল করার ঘোষণায় একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে কোমলমতি শিশুকিশোর শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে নেমে যাবে এক বিশাল বোঝা।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সচিবালয়ে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই খসড়া রূপরেখা বাস্তবায়ন হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের বইয়ের ভারে ন্যুজ হওয়া এবং কচিকাঁচা শিশুদের পরীক্ষা ভীতি কমে তাদের মুখে হাসি ফুটবে বলে আমরা আশা করতে পারি। জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা উপস্থাপন শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন গণভবন থেকে অবলোকন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই অবলোকনকালে তিনি বলেন, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এজন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে সময়োপযোগী করা একান্ত অপরিহার্য( দৈনিক পূর্বদেশ, তাং ১৪/০৯/২১)। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার খসড়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আনন্দময় পরিবেশে পড়াশোনা, বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানো,গভীর শেখনে গুরুত্বারোপ, মুখস্ত নির্ভরতাকে নিরুৎসাহিত করে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেন। সে সাথে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
খসড়া রূপরেখা পর্যবেক্ষণ করলে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টতর হয়ে ওঠে তারমধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিক হলো ২০২৩ সাল থেকে আর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা থাকছে না। এতে করে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল পরিমাণ মূল্যবান অর্থের যেমন সাশ্রয় হবে তেমনি আমাদের কোমলমতি শিশুকিশোরদের মাথার ওপর থেকে নেমে যাবে একটি বিরাট বোঝা। জিপিএ-৫ নামক অদ্ভুত বিষয়ের পিছনে ছোটাছুটি করে আমাদের মা-বোনদের জুতার তলা আর ক্ষয় করতে হবে না। যদিও ২০২২ সালে এই দুটো পরীক্ষার ভবিষ্যৎ কি হবে তা রূপরেখায় স্পষ্ট করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা থাকছে না। এই সিদ্ধান্তে কোমলমতি শিশুদের টানাহেঁচড়া যেমন কমবে তেমনি পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের টেনশনের মাত্রা হ্রাস পাবে। এই তিনটি শ্রেণিতে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন কথা বলা হয়েছে। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করা হবে বিধায় শিশুরা কোনো প্রকার মানসিক চাপ ছাড়াই বাসা-বাড়িতে ফিরবে এবং নিজের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ পাবে। বাসায় ফিরে আবার যন্ত্রের মতো কোনো টিচার বা কোচিং-এ ছুটতে হবে না। তৃতীয়তঃ নবম দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ বিভাজন তথা মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান নামে কোনো বিভাগই থাকবে না। সকলকে অভিন্ন বিষয়ে পাঠ নিতে হবে। এটাও একটা ভালো দিক। চতুর্থতঃ এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির সিলেবাসের ভিত্তিতে। এতে করে বিশাল আকৃতির গাইড/ সহায়কগ্রস্ত ব্যবহার করা থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পাবে। একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষায়ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি অনেকাংশেই কমে যাবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা আলাদা সিলেবাসে পরীক্ষা হবে এবং এই দুই শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল দেওয়া হবে।
সরকার যেভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রমের খসড়া উপস্থাপন করেছে তা যদি আরও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় তা হবে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের জন্য উত্তম উপহার। এটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে একটি বিরাট সুফল বয়ে আসবে। আমরা চাই না আমাদের নতুন প্রজন্ম বার বার পরিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের নামে নানা হয়রানির শিকার হোক। আমরা চাই এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু হোক যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ নেবে আনন্দ ও বিনোদনের মাধ্যমে। একটি ছবি যেমন হৃদয় ছুঁয়ে হৃদয়ের গহিন ভিতর স্থায়ী চাপ রাখতে পারে, একটি বাক্য যেমন একবার পাঠ করার পর আর ভুলে যাওয়ার কথা নয় পাঠ্যসূচিও হতে হবে ঠিক তেমনটি। সোজা কথায় মানসিক চাপমুক্ত একটি নির্ভার সিলেবাস, যা রপ্তকরণের জন্য ছোটাছুটি করতে হবে না কোনো
কোচিং সেন্টারে। দৌড়াতে হবে না বিষয়ভিত্তিক টিচারের পেছনে। রাখতে হবে না কোনো প্রাইভেট টিউটর। কিনতে হবে না সহায়ক বইয়ের নামে অজস্র ভুলে ভরা গাইড বই। লোপ পাবে জিপিএ-৫ নামের অদ্ভুত প্রবণতা। আমাদের মনে রাখতে হবে মেধাবী বলতে শুধু ভালো মার্ক পাওয়া শিক্ষার্থী নয়, নানা কারণে অনেক মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীও পরীক্ষায় খারাপ করতে পারে। তাই মূল্যায়নটা হওয়া চাই বছরের শেষে একটি পরীক্ষার ভিত্তিতে নয়। একজন শিক্ষার্থীর আচার আচরণ, ক্লাসে উপস্থিতি, সাপ্তাহিক বা প্রতিমাসে গৃহীত বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে এবং একমাত্র এভাবেই প্রকৃত মেধাবীদের স্বরূপ অনায়াসে বেরিয়ে আসবে। আমরা আমাদের সব কটা জানালা সেই সুবর্ণদিনের শিক্ষাক্রমের প্রত্যাশায় খুলে দিলাম।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক