৯ ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি

33

রাহুল দাশ নয়ন

সন্দ্বীপের চার ইউনিয়নে বিনাভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত চার প্রার্থী। বাকি আট ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত দুই প্রার্থী। ছয় ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও তাঁদেরকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে। একই অবস্থা কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায়। এই তিন উপজেলার সাত ইউনিয়নে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা। একটি ইউনিয়নে ফলাফল স্থগিত রাখলেও সেখানে জাপা সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এগিয়ে আছেন।
অযোগ্যদের মনোনয়ন, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া, বিএনপি-জামায়াতের ভোট কাছে টানতে চাওয়া, দলীয় গ্রুপিং-বিভাজন, স্থানীয় সাংসদ ও দলীয় নেতারা নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই ৯টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের এমন ভরাডুবি হয়েছে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এমনকি পরাজিত হওয়া কয়েকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের অবস্থান তৃতীয় কিংবা চতুর্থ। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা আট ইউনিয়নে জয়ী হয়েছি। টেকনাফে একজন বিএনপির প্রার্থী জিতেছে। কেন দলীয় প্রার্থীরা হেরেছে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনায় বসেছি। প্রার্থী মনোনয়নে ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠু হয়েছে।’
কক্সবাজার আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের দুইজন নেতা জানান, টেকনাফে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি নিজেও কয়েকজন দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদও এক প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবে জাফর আহমদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও বদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চকরিয়ায় দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে সংসদ সদস্য জাফর আলমের ভাতিজা জিয়াবুল হক প্রার্থী হন। সবমিলিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন ইউনিয়নে ৩৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এরমধ্যে ১৫ জন প্রার্থী ও প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা ব্যক্তিদের বহিষ্কার করা হলেও ভোটে তার প্রভাব পড়েনি। অনেক জায়গায় বিএনপি ও জামায়াত ভোটারদের কাছে টানতে আওয়ামী লীগ প্রচেষ্টায় ছিল। যা ত্যাগী নেতাকর্মীরা মানতে পারেনি। কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন মানতে না পেরে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষেও নীরবে কাজ করেছেন।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মগধরা, বাউরিয়া, মুছাপুর, মাইটভাঙ্গা, সারিকাইত, হারামিয়া, গাছুয়া, সন্তোষপুর, আমানউল্লাহ, হরিশপুর, রহমতপুর, আজিমপুর ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে বিনাভোটে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। নির্বাচন হওয়া আটটি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে হেরেছেন দলীয় প্রার্থী। আমানউল্লাহ ইউনিয়নে আনারস প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী সাইফুল ইসলাম। আজিমপুরে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন আনারস প্রতীকের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. রকি।
সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহজাহান বিএ পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রশাসনের কারণেই দলীয় প্রার্থী দুটি ইউনিয়নে জিততে পারে নাই। অযোগ্য প্রার্থীদের সেখানে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল।’
সন্দ্বীপের আমানউল্লাহ ইউনিয়নে পরাজিত হওয়া আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মাহবুবুল আলম নওশাদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘তিনটি কেন্দ্র দখল করে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে। স›দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান সাহেব সরাসরি আমার বিরোধিতা করেছেন। উনি এমপির বিরোধিতা করতে গিয়েই আমার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। এমনকি আমার নির্বাচনী কিংবা দলীয় কোনো সভাতে উনাকে আমন্ত্রণ জানালেও যাননি। অথচ অন্য প্রার্থীদের সাথে গেছেন।’
টেকনাফের হ্নীলা, সাবরাং, টেকনাফ সদর, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মধ্যে একটিতে ফলাফল স্থগিত রয়েছে। বাকি তিনটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। ফলাফল স্থগিত থাকা হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন জামায়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী। স্থগিত থাকা দুই কেন্দ্রে ৪৪২৫ ভোট আছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে নুর আহমদ আনোয়ারী ২০৪৩ ভোটে এগিয়ে আছেন। টেকনাফ সদর ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউর রহমান জিহাদ মোটরসাইকেল প্রতীকে ৯৪৬৮ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। নিকটতম প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া চশমা প্রতীকে পেয়েছে ৭৯৫২ ভোট। সেখানে আওয়ামী লীগ দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবু ছৈয়দ ১৮৬৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। সাবরাংয়ে জিতেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নুর হোসেন আনারস প্রতীকে ১৪৭৪৬ ভোট পেয়ে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে দলীয় সোনা মিয়া পেয়েছেন ৯৮৭১ ভোট।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নে পরাজিত হওয়া আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবু ছৈয়দ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেন পরাজিত হয়েছি আপনারা বের করেন। আমার পক্ষে উপরে থাকলেও ভেতরে টাকার পেছনে ছুটেছে অনেক নেতা। বড় নেতারাও আমার বিরুদ্ধে করেছে। আমাকে এভাবে পরাজিত করতে হলে মনোনয়ন দেয়া দরকার ছিল না।’
মহেশখালীতে অনুষ্ঠিত মাতারবাড়ি, হোয়ানক, কুতুবজুম ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। মাতারবাড়ি ইউনিয়নে অধিক সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এরমধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এসএম আবু হায়দার জয়লাভ করেছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এনামুল হক চৌধুরী টেলিফোন প্রতীক নিয়ে হায়দারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছেন। কুতুবজোম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এড. শেখ কামাল জয়ী হয়েছেন। সেখানেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মাথাব্যথার কারণ হয়েছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী চশমা প্রতীকের মোশারফ হোসেন খোকন। হোয়ানক ইউনিয়নে জয়ী হয়েছেন পাতা প্রতীকের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মীর কাশেম চৌধুরী। মোটরসাইকেল প্রতীকের আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী ওয়াজেদ আলী মুরাদ নিকটতম প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। হোয়ানকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোস্তফা কামাল চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ, উত্তর ধুরং, লেমশীখালী, দক্ষিণ ধুরং, কৈয়ারবিল, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের মধ্যে বড়ঘোপের একটি কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত থাকায় সেখানে কাউকে জয়ী ঘোষণা করা হয়নি। বিজয়ী ঘোষণা করা বাকি পাঁচ ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতেই জয়ী হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী। সেখানে দক্ষিণ ও উত্তর ধুরংয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অবস্থান ছিল তৃতীয়। দুই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জয়ী হলেও ব্যবধান ছিল অল্প। একটিতে জাপা সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এগিয়ে আছেন।
আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সিকদার ৪৪৬৭ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ফিরোজ খাঁন চৌধুরী ৪২২০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত এই দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। কৈয়ারবিল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ আজমগীর মাতবর ১৮৩৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী জালাল আহমদ মোটরসাইকেল প্রতীকে পেয়েছে এক হাজার ৭৭৪ ভোট। লেমশীখালী ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত চশমা প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আকতার হোসেনের কাছে ৩০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রেজাউল করিম। দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত চশমা প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আলাউদ্দিন আল আজাদ ৩৯৬৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নিটকতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছৈয়দ আহমদ চৌধুরী ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ৩৪৮৮ ভোট। সেখানে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থী আজম সিকদার পেয়েছেন ৪৭২ ভোট। উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হালিম সিকদার ৬০৫১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিরাজদ্দৌল্লাহ মোটরসাইকেল প্রতীকে পেয়েছেন ৩১৭২ ভোট। সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থী ইয়াহিয়া খান ৪৯২ ভোট পেয়েছেন। বড়ঘোপ ইউনিয়নে ৪৪৪৯ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন জাপা সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী শহীদ উদ্দীন ছোটন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল কালাম পেয়েছেন ৪১১০ ভোট। মারামারির কারণে একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় এই ইউনিয়নের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। স্থগিত ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা ২২০০।
কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরং ইউনিয়ন নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী ইয়াহিয়া খান পূর্বদেশকে বলেন, ‘জয়ী প্রার্থীর ভাইয়ের টাকায় আওয়ামী লীগ নেতারা বেচাকেনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীও আমার পরাজয় নিশ্চিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমার সাথে সমাবেশে বক্তব্য রাখলেও ভেতরে বিরোধিতা করেছে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিও জামায়াত নেতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরাসরি আমার বিরোধিতা করেছে।’