পরিবেশ ছাড়পত্র ও বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) ছাড়াই ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে হাটহাজারীর দেওয়ান নগর ১১ মাইল এলাকার ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। স্থানীয় প্রশাসন ও হালদা গবেষকদের মতে, ভারি বৃষ্টিপাত হলেই কর্তৃপক্ষ প্ল্যান্টের আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনের মাধ্যমে পাশের ছড়ায় (খাল) পোড়া ফার্নেস অয়েল ছেড়ে দেয়। আর এসব অয়েল চানখালী হয়ে অংকুরিঘোনা এলাকায় গিয়ে সরাসরি হালদা নদীতে পড়ে। এতে হালদা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। ইতিপূর্বে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার ছড়ায় পোড়া ফার্নেস অয়েল ছেড়েছে।
এ কারণে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে এসব জরিমানা মওকুফ করা হয়। তবে দীর্ঘ ৮ বছর পরও পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপি ছাড়া এ প্ল্যান্ট আর কত পরিবেশ দূষণ করবে- এ জিজ্ঞাসা সংশ্লিষ্টদের।
হালদা রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জাানন, এটা কত জঘন্য, একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান চোরের মতো কাজটা করে। যারা আছেন তারা তো বিবেকবান মানুষ। তারা এ কাজ করলে আমরা কোথায় যাব? তারা এতোদিন মিথ্যা বলে এসেছে, অস্বীকার করেছে। অথচ হাতেনাতে প্রমাণসহ বিষয়টি নিশ্চিত করল পরিবশে অধিদপ্তর। এভাবে তারা আর কতদিন পরিবেশ ও হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য দূষণ করবে?
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ১২ ধারা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং কাজ শেষে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে অবস্থানগত ছাড়পত্র অথবা পরিবেশগত ছাড়পত্রের কোনটিই গ্রহণ করা হয়নি, যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারার বিধানমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে হালদায় একই কায়দায় অপরিশোধিত পোড়া ফার্নেস অয়েল ছেড়ে দেয়। ওই সময় এ খবর বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হলে ১৭ এপ্রিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্ল্যান্টটির বিরুদ্ধে হালদা দূষণের অভিযোগ উঠে। এ সময় প্ল্যান্টটির বিরুদ্ধে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। এরপর ঘটনাস্থলে আসা সরকারের তালিকাভূক্ত একটি বেসরকারি সংস্থার পরিদর্শকদল হালদায় বর্জ্য পতিত হওয়ার প্রমাণ পায়। এতে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে এবং একইসঙ্গে অনতিবিলম্বে ছাড়পত্র গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।
নোটিশ দেওয়ার পরও প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র না নিলে ২২ মে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (এনফের্সিমেন্ট) মো. মুনির চৌধুরী প্ল্যান্টের দুই নির্বাহী প্রকৌশলীকে ঢাকায় তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ, শুনানি এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ পরিবেশের ছাড়পত্র ও ইটিপি তথা স্থায়ীভাবে বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার কথা জানায়। পরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে মওকুফ করা হয় জরিমানা।
২০১৮ সালে পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু প্ল্যান্টটিতে এখনও ইটিপি স্থাপন না করায় তাদেরকে আজ পর্যন্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. মাঈদুল ইসলাম। তিনি আরও জানান, ইটিপি স্থাপন করা সাপেক্ষে তদন্তপূর্বক পাওয়ার প্ল্যান্টটিতে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হবে।
এদিকে ২০১৭ সালে প্ল্যান্টটিতে ইটিপি স্থাপনে একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে চুক্তি হয়েছে বলে জানান ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপক শফিউদ্দিন আহমেদ। তিনি মুঠোফোনে জানান, গত বছরের ২০১৮ সালে মে মাস থেকে পাওয়ার প্ল্যান্টে আমরা বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। তবে মাঝে কিছু ডিজাইন পরির্বতনের কারণে বিলম্ব হচ্ছে।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে প্ল্যান্টটিতে ইটিপি স্থাপন কাজ সম্পন্ন হবে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার ভোররাতে ভারি বর্ষণের সুযোগ নিয়ে পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বর্জ্য ও পোড়া ফার্নেস অয়েল ছড়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন এমন প্রমাণসহ ঊর্ধ্বতন মহলে তা উপস্থাপন করেন। খবর পেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা পরিবেশ দূষণের অভিযোগে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নোটিশ দেন। এছাড়া অধিদপ্তর অফিসে আগামী ১৭ জুলাই শুনানিতে অংশ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আব্দুর রহমান মল্লিক।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি আমি অবহিত হয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের সাথে আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
প্রায় ৮ বছর আগে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৯০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১০০ মেগাওয়াট ডুয়েল-ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্টটি নির্মাণ করেছে। এতে ৮.৯ মেগাওয়াট সম্পন্ন ১১টি ইউনিট রয়েছে। ১১টি ইউনিট প্রায় ৯৮.১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। আর এজন্য প্রয়োজন ২৫০ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়ল বা ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এ পাওয়ার প্ল্যান্টটি পরিচালনা করছে।