৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির মহাকাব্য : বাঙালির বাতিঘর

48

মিখাইল মোহাম্মদ রফিক

বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। জয় বাংলা। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ‘একটি কবিতা লেখা হবে আজ। তার জন্য অপেক্ষায় উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে। ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে কখন আসবেন কবি?’ সে দিন যারা রমনা রেসকোর্সের জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তাদের জন্য সেটি এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তর্জনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বললেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই থেকে জনসমুদ্রের স্বাধীনতা শব্দটি একান্তভাবে আমাদের। কী অসাধারণ রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শন সম্বলিত এ ভাষণ। পেছনে বন্দুকের নল সামনে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর শ্রোতা। বঙ্গবন্ধু দীপ্ত প্রত্যয়ে একটি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। একটি নিরস্ত্র জাতিকে সুসংগঠিত ও সশস্ত্র করে গড়ে তুলতে এমন একটা আশ্চর্য জাদুকরী পাÐুলিপিহীন ভাষণ যা তাঁর সম্পূর্ণ চিন্তাশীল মনন জগত হতে উচ্চারিত। যা হয়ে গেল রাজনীতির অমর কবিতা। মহাকাব্য। বজ্রকন্ঠের এই ভাষণ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে দেখিয়েছে আশার আলো দিক-নির্দেশনা। প্রত্যয়মন্ত্রে জেগেছে বাঙালি। সেই ধারাবাহিকতায় ন’মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দামালেরা ছিনিয়ে আনে লাল সবুজের বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক সাতই মার্চের ঐতিহাসিক এ ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি প্রজন্মান্তরে এ ভাষণের গুরুত্ব অনুশীলন ও অনুধাবন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সেই দিনের ঐতিহাসিক এই ভাষণের অডিও ভিডিও ধারণ ও সংরক্ষণ কার্যের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রশাসনের যে অস্থিরতা ছিল তারই একটি প্রামাণ্য ইতিহাস নির্মাণ হয়েছে টেলিফিল্ম মহাকাব্যে। আজও স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশে সেই অস্থিরতার নেপথ্য কূটকৌশলীরা বিদ্যমান। কূটকৌশল থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর অসা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সাহসী ভূমিকায় জাগ্রত থাকতে হবে।
তোমাকে অভিবাদন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মহা ভাষ্য’র মহা কাব্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ছবি নয়, জীবন। এক মস্তবড় গাঁট বা দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র নির্মাণ করল এক ‘মহাকাব্য’। যে ধারায় চলছে টিভি সিরিয়াল বা টেলিফিল্ম তার ঘরানায় মহাকাব্য’র আত্মপরিচয় আত্মদম্ভের বার্তায় সব বিনোদন চৌপাট হয়ে যায়।
এমন একটা টেলিফিল্ম যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে উঠল ‘মহাকাব্য’। এই টেলিফিল্মে ভাষনের সঙ্গে চিত্রকল্পে পরতে পরতে মিলিয়ে দিলেন ভেঙে পড়া মানুষদের জীবনের সেরা মুহূর্ত, বোঝাপড়া ! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য পাগল এই গল্পের চরিত্রদের সাফল্য কামনায় আমরা দর্শকেরা শ্বাস আগলে বসে থাকি।
৭ মার্চের ভাষণ থেকে ইতিহাস হয়ে ওঠা সাংবাদিক চরিত্রে রাশিদের জীবন অভিনয় কী একটা নতুন দিশা দেখানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল ! মেসেজের ভারে এমন প্রকল্পর দফারফা হয়ে যাওয়ার কথা। তা তো হয়নি। বরং থ্রিলার হিসাবে গড়া কাহিনিতে শেষ অবধি ছিলো সাসপেন্স, সংলাপে-সংলাপে ধরানো ব্যক্তিত্ব সংঘাত ও হিউমার ও অন্যান্য সুর ও আবহে পুরো টেলিফিল্মটাই যেন একটা পরিপূর্ণ মহাকাব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দিয়ে টেলিফিল্মের কথা শুরুও করা যায় না। ৭ মার্চ বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রযোজনা দেখে আমরা দর্শকশুভানুধ্যায়ী উদ্বেলিত হয়েছি। দর্শক জানল ৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষন রক্ষা করার গল্প। সে ভাষণ রক্ষা করতে গিয়ে চরিত্রের মানুষগুলো জীবন ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রর ‘মহাকাব্য’ও একটা থ্রিলারই বলব। এবং সেই মহান নেতার আদর্শ ধারন করে রাশিদ চরিত্রে এস এম বাহাউদ্দিন এর অভিনয় প্রতিবাদী নিবেদন।
‘মহাকাব্যে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র বাহাউদ্দিন গণমাধ্যম কর্মী অফিস পলিটিক্স বৃত্তে হাঁপিয়ে ওঠা একজন। সে কাজপাগল মানুষ যে তার সংসারের প্রয়োজনটুকুও শুনতে পায় না। তার স্ত্রীর চরিত্রে বৃষ্টি স্বামীকে মনের কথা বলার সুযোগ পায় না। এরকম কাজে, বলাবাহুল্য শুরুটাই সমস্যা, শেষ দূরস্থান। অথচ এইখানেই আবির্ভাব গল্পে রোকেয়া খাতুন, প্রকৃত সমস্যা, অজগ্র অপরাধে ফাসা ইকবাল চরিত্রে ছত্রপতি। সৌম্যর এ চিত্রনাট্যকে ছন্দে এবং দৃশ্যের বিস্তারে ক্যামেরার বেশ কিছু দুর্বলতা ছিলো সিনেমাটোগ্রাফার হাসিবের। যে কাজ আরও নিপুণ নিটোল ভাবে সম্পাদনা হতে পারতো। তারপরও একটা প্রধানত কষ্টের ছবিকে সহনীয়, এমনকী আরামপ্রদ করেছে। সব দুঃখ কষ্ট আশা-আকাক্সক্ষা, জয়-পরাজয়, ফলিয়ে টেলিফিল্মটি গড়ে তোলে চট্টগ্রামেরই কারিগরী টিম ও অভিনেতাগণ। বস হিসাবে মাইন উদ্দিন সুন্দর একটা ভূমিকায় বেশকিছু সিকোয়েন্সকে রস জুগিয়েছে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের লোকবল দ্বারাই নির্মিত মহাকাব্য কিছুটাও হলেও প্রশংসার দাবি রাখে। যাকে আরও ঋদ্ধ করেছে আমজাদ আলী খন্দকার আর মইনুল হাসানের স্বিকার উক্তি। মহাকাব্য নিয়ে এতো বড় আয়োজন দেশে এই প্রথম। এর প্রশংসার দাবিদার বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার শ্রী নিতাই কুমার ভট্টাচার্য নির্মাতা অরিন্দম মুখার্জি সহ এর সকল কলাকুশলী।
লেখক: নাট্যকর্মী ও সাংবাদিক