৫২ দিনে চট্টগ্রাম কারাগারে ৫ বন্দির মৃত্যু

26

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের দুই বন্দি হঠাৎ ‘অসুস্থ’ হয়ে এক ঘণ্টার ব্যবধানে হাসপাতালে মারা গেছেন। তারা দুইজনই চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে রফিক উদ্দিনের (৪৫) বাড়ি ধোপাছড়ি ইউনিয়নে। আর বাবুল মিয়া (৪০) ছিলেন হাছনদন্ডীর বাসিন্দা। রফিক মারামারি এবং বাবুল মাদক মামলায় কারাগারে ছিলেন। দুইজন কারাগারে এসেছেন বেশি দিন হয়নি। রফিককে চলতি বছরের ২৭ মার্চ এবং বাবুলকে গত বছরের ১৮ নভেম্বর কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাল সোমবার তারা লাশ হয়ে বের হয়েছেন কারাগার থেকে। একইদিনে দুইজনের মৃত্যুকে ঘিরে আতঙ্ক বিরাজ করছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে। ৬ দিন আগে কারাগারে বন্দি অবস্থায় অসুস্থ মো. শাহজাহান নামে এক যুবদল নেতার মৃত্যু হয়। মাদক আইনসহ তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা ছিল বলে পুলিশের দাবি। যুবদলের নেতাদের দাবি, রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য তাকে মাদকের মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম। মৃত মোহাম্মদ শাহজাহান (৪৭) নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার উত্তর কুলগাঁও এলাকার মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে। বায়েজিদ বোস্তামি থানায় মাদক আইনে দায়ের হওয়া এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর শাহজাহান কারাগারে যান। শেষ পরিণতিতে তিনি লাশ হয়ে পরিবারের সামনে উপস্থাপিত হন।
এদিকে কারাগারে বিভূতিভূষণ ভৌমিক (৬০) নামে আরও এক হাজতি মারা যান গত ১২ ফেব্রæয়ারি রাত পৌনে ৮টায়। এসময় কারাগার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিভূতিভূষণ ভৌমিকের বাবার নাম হরিভূষণ ভৌমিক। বিভূতিভূষণের হাজতি নম্বর-২১৪৩৮/২১।
তথ্যমতে, ২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে একেএকে পাঁচজন হাজতির মৃত্যুকে ঘিরে কারা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অসুস্থ বন্দিকে কারা হাসপাতাল কিংবা বাইরে চিকিৎসা দেয়ার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার অভিযোগ করেছেন ভিকটিমদের পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, কারাগারের ভেতরে অসুস্থ হলেও সময় মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
তথ্যমতে, গতকাল সোমবার ভোরে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে দুইজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তারা মারা যান বলে কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও ভিকটিমদের পরিবারের দাবি ভিন্ন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রফিক ও বাবুল দুইজনই চন্দনাইশ থানার আলাদা দুইটি মামলায় কারাগারে ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বাবুল রোজা রাখার জন্য সেহেরি খেয়েছিল। বিছানায় যাওয়ার পর বুকে ব্যথা অনুভব করার কথা জানান। আর রফিক অসুস্থতা অনুভব করায় তাকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এদিকে রফিকের পরিবারের দাবি, ‘ধোপাছড়ির ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নির্দেশে’ গত ২৬ মার্চ তার ওপর হামলা করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। হামলায় আহত হয়ে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তার মামলা না নিয়ে উল্টো তাকে আসামি করে কারাগারে পাঠায়। সেসময় থানায় রফিককে পুলিশ সদস্যরা মিলে আরও এক দফা মারধর করে। জানা গেছে, রফিকের সাথে ধোপাছড়ির চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমের জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল।
এ বিষয়ে রফিকের বড় ভাই জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘ধোপাছড়ি ইউনিয়নের চিড়িংঘাটা এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন রফিক। গত ২৬ মার্চ সকালে তাদের চাচির জানাজা শেষে ফেরার পথে স্থানীয় ‘ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে’ রফিকের ওপর হামলা হয়। স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বিকেলে রফিক থানায় মামলা করতে যায়। কিন্তু পুলিশ তার মামলা না নিয়ে, অপর পক্ষের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায়। ওই রাতে থানা হাজতে রাখার পর পরদিন কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।’ জামাল বলেন, ‘হামলায় আহত হওয়ার পর রফিককে চিকিৎসা না দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে রফিকের মৃত্যু হয়েছে।’ তবে এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে চন্দনাইশ থানা কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়েছে।
কারাগারে একেরপর এক মৃত্যুর ঘটনায় সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জানান, কারাগারে মৃত্যু হলে পোস্টমর্টেম হওয়ার জরুরি। এতে আইনগত পথে হাঁটতে সুবিধা হয়। পুলিশি হেফাজতের পরিণতিতে মৃত্যুর বিষয়টি আসলে এ নিয়ে মামলা হতে পারে। এক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারকে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বন্দি মানুষের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কারাগারে প্রতিটি মৃত্যুর পোস্টমর্টেম জরুরি।