৫০ বছরে টি কে গ্রুপ

207

পূর্বদেশ ডেস্ক

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত টি কে গ্রুপ এ বছর ৫০ বছরে পা রেখেছে। দুই ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম এর নামের সঙ্গে মিল রেখে সৃষ্টি হয় টি কে (তৈয়ব-কালাম) গ্রুপ। গ্রুপটির এখন উৎপাদনমুখী কারখানার সংখ্যা ৪৩টি। এসব কারখানায় ৪০০টির বেশি ইউনিটে দিন-রাত চলছে পণ্য উৎপাদন। কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। বার্ষিক টার্নওভার ১৮ হাজার কোটি টাকা। গ্রুপটি প্রতিবছর সরকারকে দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালামের বাবা মীর আহমেদ সওদাগর একসময় মিয়ানমারের রেঙ্গুনে ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে চট্টগ্রামের চাক্তাই ফিরে এসে দোকান খোলেন। ১৯৭২ সালে ছেলে মোহাম্মদ আবুল কালামকে এক হাজার কেজি ধান বিক্রির টাকা দেন ব্যবসার জন্য। ধান বিক্রির ১ হাজার ৮০০ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু। ব্যবসার তালিকায় যুক্ত হয় ভোজ্যতেল ও মসলা। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেন তারা। ১৯৮৩ সালে সয়াবিন পরিশোধন কারখানার লাইসেন্স নেন। ১০০ টন পরিশোধনক্ষমতার কারখানা গড়ে তোলেন ১৫০ জন কর্মী নিয়ে কালুরঘাটে। নাম দেওয়া হয়- টি কে অয়েল রিফাইনারি। এটি ছিল বেসরকারি খাতে প্রথম কারখানা।
টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘স্বাধীনতার পর রান্নায় সয়াবিন তেলের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ওই সময় সরাসরি পরিশোধিত আকারে সয়াবিন তেল আমদানি হতো। পরে চাহিদা বাড়তে শুরু করলে আমরা কারখানা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ২০০৮ সালে বিদেশি সরবরাহকারীর সঙ্গে ১ হাজার ৪০০ ডলারে সয়াবিন তেল আমদানির চুক্তি হয়েছিল। কয়েকটি চালানের চুক্তির পর সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেক হয়ে যায়। সে সময় আমদানিকারক দেশগুলোর অনেকেই পিছুটান দিয়েছিল। তবে লোকসান হবে জেনেও ঋণপত্র খুলেছিলাম। লোকসানও দিয়েছি। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা ও খুলনায় চারটি পরিশোধন কারখানা থেকে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা হচ্ছে।’
শুধু পরিশোধনের কারখানা নয়, নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন বীজ মাড়াই করে তেল ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের কারখানায় বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। আটা-ময়দার কারখানাও গড়ে তুলেছে গ্রুপটি। পুষ্টি ব্র্যান্ড নামে ভোজ্যতেল ও আটা-ময়দা বাজারজাত করছে গ্রুপটি।
আশির দশকে কাঠের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পার্টিকেল বোর্ড কারখানা গড়ে তোলা হয়। নাম দেওয়া হয়-টি কে পার্টিকেল বোর্ড মিলস। আর এখন পার্টিকেল বোর্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে টি কে সুপার বোর্ড। দেশে মোট পার্টিকেল বোর্ডের এক-চতুর্থাংশের বেশি উৎপাদিত হচ্ছে এই গ্রুপের কারখানায়।
সয়াবিন পরিশোধনের কারখানার পর রড তৈরির কারখানা টি কে রি-রোলিং মিলস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৭ সালে ফৌজদারহাটে গড়ে তোলা হয় ঢেউটিন তৈরির কারখানা এনআর স্টিল গ্যালভানাইজিং। বর্তমানে গ্রæপের দুটি কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন হচ্ছে। যা ঈগল ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করা হচ্ছে।
১৯৯১ সালে এলপিজি রাখার সিলিন্ডার উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলে টি কে গ্রুপ। প্রতিদিন ৪০০টি সিলিন্ডার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কারখানাটির। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং কারখানা দরপত্রের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে টি কে গ্রুপ নিয়ে নেয়। কারখানাটি ২০০০ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের হাতে গেলেও যৌথ অংশীদারত্বে প্রিমিয়ার সিমেন্ট কারখানায় বিনিয়োগ করেছে তারা।
কালুরঘাটে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত রিফ লেদার কারখানা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রথম বৈশ্বিক মানসনদ অর্জন করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে চামড়া রপ্তানি হচ্ছে রিফ লেদারের।
১৯৯০ এর দশকে ফটিকছড়ির বারমাসিয়া চা-বাগান এবং এরপর যুক্ত হওয়ি আরও দুটি বাগানে গত বছর ১৮ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। পুষ্টি ব্র্যান্ড ও রাঙাপানি ব্ল্যাক টি নামে বাজারজাত হচ্ছে টি কে গ্রুপের চা।
১৯৯১ সালে টি কে কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নামের কাগজের কারখানা গড়ে ওঠে। ২০০৩ সালে সোয়েটার কারখানায় সরবরাহের জন্য অ্যাক্রিলিক সুতা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে টি কে গ্রুপ। চীন হুং ফাইবার্স লিমিটেড নামের এ কারখানায় প্রতিদিন ৬২ টন বিভিন্ন ধরনের সুতা উৎপাদিত হয়।
টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালামের সন্তান মোস্তফা হায়দার দেড় দশক আগে কালুরঘাটে রাসায়নিক উৎপাদনের কারখানা ‘সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড’ গড়ে তোলেন। এই কারখানা বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদন করছে। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে এই হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ডাঙ্গারচরে জ্বালানি পণ্য উৎপাদনের বেসরকারি খাতের প্রথম কারখানা সুপার পেট্রোকেমিক্যালের মালিকানা আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। গ্যাসের উপজাত কনডেনসেট ও ন্যাপথা প্রক্রিয়াজাত করে এই কারখানায় অকটেন, ডিজেল, জাইলিনসহ জ্বালানির পাশাপাশি নানা ধরনের জ্বালানি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
মোস্তফা হায়দার বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে মডার্ন সিনটেক্স টেক্সটাইল গ্রেডের প্লাস্টিক চিপস তৈরির কারখানা গড়ে তুলছেন। এ প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সামুদা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রাসায়নিক দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের কারখানায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। এতে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ ছাড়া মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ধলঘাটা) টি কে গ্রæপের অপর প্রতিষ্ঠান সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড ৪১০ একর ও সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ১০০ একর জমি নিয়েছে। সেখানে কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
টি কে গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিন সন্তান হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা, আবু সাদাত মোহাম্মদ ফয়সাল ও তালহা বিন তৈয়ব শতভাগ রপ্তানিমুখী ম্যাফ শুজ লিমিটেড ও ম্যাফ নিউজপ্রিন্ট কারখানা গড়ে তুলেছেন। বিনিয়োগ করেছেন কৃষি খাতেও। গড়ে তুলেছেন ম্যাফ ফার্মিং নামের প্রতিষ্ঠান। গত বছর ৬৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে ম্যাফ শুজ লিমিটেড। মোহাম্মদ আবু তৈয়বের সহধর্মিণী লায়লা বিলকিস বর্তমানে গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছে অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম। দুই ভাইয়ের সন্তানেরা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
গ্রæপটি পটিয়ায় গড়ে তুলেছে একটি হাসপাতালে, যেখানে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা মিলছে। পামাপাশি স্কুল, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে গ্রুপটি।